শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই ভারতের হত্যাযজ্ঞ by বশীর আহমেদ

য়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ভারত। ২০০০ সালের পর গত একযুগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১০০৬ নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এ সময় ভারতের সঙ্গে অন্য পাঁচটি সীমান্তে একটি হত্যার ঘটনাও ঘটেনি।

সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, মানবাধিকার সংগঠন এবং কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্তেও গত ১০ বছরে কোনো বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শুধু বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কেন এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে—এর জবাবে ভারতীয় হাইকমিশন বলেছে, সীমান্তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গরু চোরাচালানকে উত্সাহিত করায় এ ঘটনা ঘটছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছরে ৮৭৩ জন নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। নতুন বছরে গত ৩ সপ্তাহে ৩ জন নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারত। ২০১১ সালে ৩৪ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৪ সালে ৭৬ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন এবং ২০০০ সালে ৩৯ জন নিরীহ বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে।

গত ১০ বছরে ভারতের অন্যান্য সীমান্তে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, তা নিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারি দফতর, দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ওইসব সীমান্তে কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি।
ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তান হাইকমিশন এবং একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর সীমান্ত এবং বাকিটা ওয়ার্কিং বাউন্ডারি বা দু’দেশ কর্তৃক অনুমোদিত সীমান্ত এলাকা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত ওয়ার্কিং বাউন্ডারিতে কোনো বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়া তো দূরের কথা, কোনো গোলাগুলির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। এই সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারিদের ধরার জন্যও কোনো প্রকার গুলি চালানো হয় না। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর সীমান্তে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল দুই দেশ। সীমান্তের দুই পাশে প্রায় ৮ লাখ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে দু’দেশের। ২০০২ সাল পর্যন্ত দুই পক্ষ ভারী মেশিনগান এবং মর্টারের মতো অস্ত্র দিয়ে প্রতিনিয়ত গোলাগুলি করেছে। এই গোলাগুলির মাঝে পড়ে কখনও কখনও দু-একজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। কারণ ওই সময় কাশ্মীর সীমান্তে পুরোপুরি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। ২০০২ সালে দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর সীমান্তে আর কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। গত ৯ বছর সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
চীনের সঙ্গেও ভারতের বৈরী সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও ভারত-চীন সীমান্তে কোনো রকমের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় না। ভারত-চীন সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকায় চীনা দূতাবাস থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চীন সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে—এমন কোনো কাজ কখনও করবে না ভারত।
চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ ঝেং জিয়াং হু ভারত-চীন সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা কখনও ঘটে না।
ঢাকায় নেপাল দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি অতয় ই ভারতের সঙ্গে নেপালের সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার দেশ-কে বলেন, আমাদের জন্য ভারতের সীমান্ত উন্মুক্ত। ভারতে যেতে নেপালের জনগণের কোনো ভিসা লাগে না। সীমান্ত পরিস্থিতি পুরো শান্তিপূর্ণ। ভারত-ভুটান সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে ওয়াই থিনলের প্রেস অ্যাটাশে ডিকে সি গিয়েনসিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কখনও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না আর গুলি চালানোর মতো ঘটনা তো চিন্তাই করা যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, সীমান্ত নিয়ে আমাদের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই।
সীমান্তে এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে চেয়ে গত ২৩ জানুয়ারি আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে একটি ই-মেইল পাঠানো হয়। ই-মেইলে জানতে চাওয়া হয়, ‘বেসামরিক নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ যে আচরণ করছে, অন্য যেসব দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে সেসব সীমান্তে কি বিএসএফ একই আচরণ করে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে গত ১০ বছরে ওইসব সীমান্তে বিএসএফের হাতে কতজন নিহত হয়েছে? উত্তর যদি না হয়, তাহলে শুধু বাংলাদেশ সীমান্তে কেন ভারত ‘শ্যুট অ্যান্ড কিল’ পলিসি গ্রহণ করেছে?’ ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল) মনোজ কুমার মহাপাত্রের কাছে পাঠানো এই প্রশ্নের কোনো লিখিত জবাব পাওয়া যায়নি।
ই-মেইলে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে গত রাতে টেলিফোনে মনোজ কুমার মহাপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি খুলনায় ছিলাম। তাই আমি এর উত্তর দিতে পারিনি। তবে আপনার ই-মেইলটি আমি আমাদের দিল্লি অফিসে পাঠিয়েছিলাম উত্তর দেয়ার জন্য।
সীমান্তহত্যার ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হলো— আমরা সীমান্তহত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চাই। এজন্য বিজিবির সাহায্য প্রয়োজন। প্রতিদিন ২০০-৩০০ গরু চোরাকারবারি অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়।
বিজিবি যদি এদের নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে হত্যার ঘটনা ঘটবে না। বিএসএফের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না।
পাকিস্তান, চীন, নেপালসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। সেখানে তো একটি হত্যার ঘটনাও ঘটে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভারতীয় হাইকমিশনের এই কর্মকর্তা বলেন, ওইসব দেশ ভারতীয় গরু খেতে চায় না এবং গরু চোরাকারবারিদের উত্সাহিত করে না। এজন্য সেখানে কোনো হত্যার ঘটনা ঘটে না। বাংলাদেশ ভারতীয় গরু খেতে চায় এবং বিজিবি গরু চোরাচালানি উত্সাহিত করে। এজন্য সীমান্তে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
গতকাল এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে নতুন করে আর কী বলব। সীমান্তে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে, আমরা তার প্রতিবাদ করছি। একই সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছি—কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায়।
ভারতের পক্ষ থেকে বহুবার এই সীমান্তহত্যা বন্ধের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অর্থাত্ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার সীমান্তহত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সীমান্তহত্যা বন্ধ হয়নি। এখন বিএসএফ সীমান্তে রীতিমতো বেপরোয়া। গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার পাশাপাশি নারকীয় নির্যাতন চালাচ্ছে। উলঙ্গ করে নির্যাতনের মাধ্যমে বর্বর উদাহরণ সৃষ্টি করছে ভারত। বর্তমান সরকারের আমলে ২শ’রও বেশি নিরীহ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে সীমান্তে। ভারত কেন বাংলাদেশ সীমান্তে এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে—এই প্রশ্নের জবাবে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান আমার দেশ-কে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আসলে একটি মৃত্যুপ্রাচীর। এটি বিদেশি পত্রিকার ভাষ্য। ভারত সরকারের সম্মতিতেই সীমান্তহত্যা চলছে।
বাংলাদেশের মানুষের ওপর একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত এটা করছে। ভারতের ধারণা, এভাবে একের পর এক হত্যার পর একদিন বাংলাদেশের মানুষ মনে করবে সীমান্তে যা হচ্ছে তা আমাদের নিয়তি। আর তা হলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ থাকবে, আর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সীমান্তহত্যা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়, তখন আশঙ্কাটা আরও বেড়ে যায়। সীমান্তহত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জন শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.