দূর দেশ-পাকিস্তান সংকট: শেখার আছে অনেক কিছুই by আলী রীয়াজ

কোনো দেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়তি-নির্ধারিত বিষয় নয়। পাকিস্তান কোনো অবস্থাতেই তার ব্যতিক্রম নয়। রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর আচরণ, ভূমিকা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে। ওই শক্তিগুলোর প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সংকটের পরিধি ও গুরুত্ব নির্ধারণ করে। কিন্তু কোনো দেশে কোনো সময়েই সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।
তারা দেশ পরিচালনার জন্য, সমাজে তাদের কর্তৃত্ব এবং স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, সেগুলোও অংশত তাদের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে। সর্বোপরি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দ্বীপটিও বিশ্ব রাজনীতির বিবেচনায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। অর্থাৎ, দেশের বাইরের শক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। পাকিস্তানে কয়েক মাস ধরে যে অব্যাহত সংকট চলছে, তা বোঝা এবং বিশ্লেষণ করার জন্য এই মৌলিক বিষয়গুলো আমাদের সবারই মনে রাখা প্রয়োজন।
পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের আপাত চেহারা হলো, দেশের নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের সঙ্গে দেশের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ বড় রকমের বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। বিরোধের সূত্রপাত হয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত, সরকারের জ্ঞাতসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এমন অভিযোগ থেকে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের দেওয়া একটি নির্দেশ সরকার মানেনি বলে। প্রথমটিকে ‘মেমোগেট’ বলে সংবাদমাধ্যমে বর্ণনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। (এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য: পাকিস্তানের মেমোগেট: কে হারে কে জেতে? প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০১১) দ্বিতীয়টির সূচনা হয় ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যখন দেশের সুপ্রিম কোর্ট ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডিন্যান্স বা এনআরওকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এই অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ২০০৭ সালের অক্টোবরে। এর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যেসব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন রকম অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া। এসব অভিযোগ প্রত্যাহার করার ফলেই বেনজির ভুট্টো ও নেওয়াজ শরিফ স্বদেশে ফেরত আসতে সক্ষম হন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সরকার এই অধ্যাদেশের সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে। তাতে যে আট হাজার ৪১ জনের নাম ছিল, তার মধ্যে আসিফ আলী জারদারি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ গিলানিও অন্তর্ভুক্ত। এনআরও বাতিল হওয়ার অর্থ হলো, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার অব্যাহত রাখতে হবে বা চালু করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকার যেসব মামলা ও তদন্ত বন্ধ করার নির্দেশ দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো জারদারির বিরুদ্ধে সুইস কর্তৃপক্ষের একটি চলমান তদন্ত। ওই তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে সুইস ব্যাংকে জারদারির অ্যাকাউন্টে ৬০ মিলিয়ন ডলার উৎকোচের টাকা জমা আছে বলে বলা হয়েছিল। এনআরও বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আদালত সরকারকে নির্দেশ দেন, যেন সরকার সুইস কর্তৃপক্ষকে এই তদন্ত পুনরায় শুরু করতে চিঠি পাঠায়। সরকার এ-যাবৎ তা করতে অস্বীকার করে। সেই সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয় এবং তিনি ১৯ জানুয়ারি আদালতে হাজির হন।
সরকারের দাবি হলো, পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতা রয়েছে। ফলে গিলানি আদালতের নির্দেশ মানেননি। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী তিনি আদালতের নির্দেশ মানতে পারেন না। প্রেসিডেন্টের ইমিউনিটির ধারা-২৪৮ এ ক্ষেত্রে কার্যকর কি না, তা বিতর্কসাপেক্ষ এবং সে বিতর্ক যে অব্যাহত থাকছে, তা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। গিলানির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি ১ ফেব্রুয়ারি পুনরায় শুরু হবে এবং তা চলবে অনেকটা সময় ধরে।
‘মেমোগেট’কে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জারদারি-গিলানি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। ইতিমধ্যে হুসেন হাক্কানি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ও জারদারির উপদেষ্টা ফারাহনাজ ইস্পাহানি দেশ ত্যাগ করে লন্ডনে একজন সাংবাদিককে বলেছেন, তিনি পালিয়ে এসেছেন। কেননা, তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে আইএসআই অপহরণ করতে পারে। দেশের প্রতিরক্ষাসচিব বরখাস্ত হওয়ার পর আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তদুপরি সুপ্রিম কোর্ট ২০ জানুয়ারি সরকারকে এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে বলেছেন যে সেনাবাহিনীর প্রধান আশরাফ কায়ানি ও আইএসআইয়ের প্রধান সুজা পাশাকে পদচ্যুত করা হবে না। মেমোগেট কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিশন এই বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র মনসুর ইজাজকে ৯ ফেব্রুয়ারি কমিশনের সামনে হাজির হতে বলেছে। ইজাজ নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে পাকিস্তানে আসতে অস্বীকার করেছেন। সরকারবিরোধীরা অভিযোগ করছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অবমাননা করে বিদেশি হস্তক্ষেপের অনুরোধ-সংবলিত এই চিঠি জারদারির জ্ঞাতসারে পাঠানো হয়েছে। এটি দেশদ্রোহ বলেই তাদের বক্তব্য।
‘মেমোগেট’ এবং ‘এনআরও’ নিয়ে দুই ফ্রন্টে জারদারি সরকারের ওপর যে চাপ, তার কারণ কি যা বলা হচ্ছে তা-ই; নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরিই কি এর লক্ষ্য? অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানের ইতিহাসে নতুন নয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী বাদ দিলে এ-যাবৎ পাকিস্তানে ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী, চারজন গভর্নর জেনারেল এবং ১৪ জন প্রেসিডেন্ট দেশ শাসন করেছেন। এই প্রেসিডেন্টদের মধ্যে চারজন এসেছেন সেনাবাহিনী থেকে। পাকিস্তানে একসময় একজন বেসামরিক রাজনীতিবিদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন, পরে তিনিই আবার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পাকিস্তানের তিনজন প্রধানমন্ত্রী আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানে সর্বময় ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ঠুঁটো জগন্নাথ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সংবিধান নিয়েও যে ইতিহাস, তা-ও খুব ইতিবাচক নয়। প্রথম সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল নয় বছর। সব মিলে চারটি সংবিধান লেখা হয়েছে। দুটো সংবিধান সম্পূর্ণ বাতিল করার ঘটনা আছে। তিন দফা সংবিধান স্থগিত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন রকম শাসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে পাকিস্তানে। এই ইতিহাস প্রমাণ করে, মেমোগেট ও এনআরও নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই অংশ।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক অভিলাষ ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে বেসামরিক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতির অস্থিরতার অন্যতম কারণ। একই ভাবে সর্বোচ্চ আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করা ও তাঁকে ব্যবহার করার প্রবণতাও পাকিস্তানের ইতিহাসেরই অংশ। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টো সে চেষ্টা করেন। জিয়াউল হকের গোটা সময়ে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই স্থায়ী ছিলেন না। ১৯৯৪ সালে বেনজির ভুট্টো হাইকোর্টের একজন অদক্ষ বিচারককে সুপ্রিম কোর্টে পদোন্নতি দিয়ে পরে তাঁকে লাহোর হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি করেছিলেন; তাঁর মাধ্যমে হাইকোর্টে দলীয় লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বেনজির ভুট্টো যাঁকে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন, তাঁর প্রধান যোগ্যতা ছিল তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুগত। অনেকেরই মনে আছে, নেওয়াজ শরিফের সমর্থকেরা ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের ওপর হামলা চালিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে।
পাকিস্তানের তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠান—সেনাবাহিনী, সরকার ও আদালত কেউই নিষ্কলুষ নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, আশু স্বার্থোদ্ধারের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে রাজনীতিবিদেরা মোটেই কুণ্ঠিত হননি। দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এ ধরনের আচরণেরই পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তানের বর্তমান সংকট। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে এখন জারদারি-গিলানি গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলছেন বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থের জবাবদিহির মুখোমুখি হতে তাঁরা রাজি নন। সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতা ও পরিধির বাইরে গিয়ে বেসামরিক সরকারকে চাপ দিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে আপত্তিকর মন্তব্য করতে পিছপা হচ্ছে না। আদালতের বিচারকেরা ক্ষমতার এই টানাপোড়েনের অংশীদার হচ্ছেন স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
পাকিস্তানের এই অব্যাহত সংকটের দিকে সবার নজর রাখা জরুরি। সম্ভবত এ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।
ইলিনয়, ২৪ জানুয়ারি ২০১২
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.