বৃষ্টির দোলাচল এবং রোপা আমন by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

বারে রোপা আমনের শুরুটা যে খুব খারাপ হয়েছিল তা বলা যাবে না। রোপা আমন এমনিতেই বৃষ্টিনির্ভর ধান। মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়ায় বীজতলায় বীজ ফেলতে কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। কারণ ওই সময় কিশোরগঞ্জ-গাজীপুরের বিরাট এলাকা আমার ঘুরেফিরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। গত বছরের (২০১০) কথা আমার বেশ মনে আছে। শুরুতে বৃষ্টি ছিল না। তার আগেরবারেও একই অবস্থা। জেনেছিলাম, এল-নিনোর প্রভাব ছিল।


তাই খরা ছিল; কিন্তু এবার এমন কিছু এখনো শুনছি না। তার পরও আমনের জমি তৈরির পুরো সময়টা কেমন বৃষ্টিবিহীন কাটল। এখন আবার কয়েক দিন ধরে কোথাও কোথাও বেশ ভালো বৃষ্টির কথা শুনছি। গাজীপুরেও বৃষ্টি হচ্ছে, অর্থাৎ স্বাভাবিক বৃষ্টির যে ধারা তার ব্যত্যয় ঘটছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রতিফল নিশ্চয়ই। এই অবস্থায় গরম বাড়ছে। তাই জলাধার থেকে পানি বাষ্পীভবনের পরিমাণ বাড়ছে। সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণও বাড়ছে। আমাদের গত ২৫-৩০ বছরের আবহাওয়া উপাত্ত ঘেঁটে হিসাব-নিকাশ করেও আমরা এ ধারণাই পেয়েছি। তাই কথা উঠতে পারে, তাহলে তো খরা হওয়ার কথা নয়; কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। বৃষ্টি হবে বেশি বেশিই। তবে সময়ের বৃষ্টি সময়ে হবে না। আবার জায়গার বৃষ্টিও জায়গায় হবে না। রাজস্থানে বৃষ্টির কথা শুনছি। পাকিস্তানে বৃষ্টি হয়ে ব্যাপক এলাকা পানিতে সয়লাব করে দিয়েছে বলে খবরে দেখা গেছে। অনেক মরু দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে বলে খবর শুনি। কদিন আগে খবরে দেখলাম সাহারায় আবার সবুজের সম্ভাবনা। অর্থাৎ একসময় সবুজ ছিল, তারপর বৃষ্টির অভাবে মরুভূমিতে রূপান্তর। আবার তাহলে সবুজে ভরে যাবে! তাহলে আমাদের কী হবে? মরুভূমি! হয়তো বা। আমরা অশনিসংকেত পাচ্ছি। তবে সতর্ক হতে পারলে হয়তো বা তেমন কিছু হবে না। এ জন্য প্রস্তুতির দরকার আছে।
অনেক আগের প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা আমাদের এই অবস্থা হবে তা হয়তো জানতেন। না হলে সেই কোনকালে খরার জন্য ধানের দরকার হবে, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে হঠাৎ বন্যা হলে ধানের দরকার হবে, তা তাঁরা ঠাহর করেছিলেন কী করে? আমাদের দেশে একসময় কম করে হলেও ১৮ হাজার ধানের আবাদ হতো। সে তো আর যেমন-তেমন ব্যাপার নয়। ১৮ হাজার জাত মানে কম করে হলেও ১৮ হাজার বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চাষিদের তাঁদের প্রয়োজনেই বেছে নিতে হয়েছিল। এর মধ্যে খরা-ঝরা সহনশীল থেকে শুরু করে যত রকমের আধি-ব্যাধি সহনশীল হতে পারে, সবই ছিল বলে মনে করি। আর ছিল বলেই আমরা আমাদের প্রয়োজনের বৈশিষ্ট্যটাকে এখনো খুঁজে পাই। নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজে লাগাই। উল্লেখ্য, মাঠে আর ১৮ হাজার ধান নেই। আমাদের ধান গবেষণার জিনব্যাংকে সাত হাজার দেশি ধানের জাত রাখা আছে।
আমাদের দেশে ধান নিয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনা শুরু হয় আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে। তারও কিছু পর থেকে শুরু হয় কিভাবে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো যায়। তখন থেকেই খরার এবং ঝরার (জলমগ্নতা সহনশীল) ধানের খোঁজ-খবর চলছিল। সত্যি কথা বলতে কি, আজ পর্যন্তও সেই কাজটি চলছে। এখন আণবিক জীববিজ্ঞানের যুগ। জৈবপ্রযুক্তি দিয়ে মানব বা মিশ্র মানব বানানোর কথা শোনা যায়। তার পরও আমরা একটা খরা সইতে পারে বা হঠাৎ বর্ষায় ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে এমন কোনো যুৎসই জাত বের করতে পারিনি। অবশ্য কয়েক বছর আগে জলমগ্ন, সহনশীল দুটো জাত আমরা পেয়েছি। এর শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর বা তারও আগে, উড়িষ্যার কটকে। ভারতের সেন্ট্রাল রাইচ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক বিজ্ঞানী তখনকার এক দেশি জাতের মধ্যে এই গুণ খুঁজে পান। ওই জাতটিকে ঋজ১৩অ অর্থাৎ Flood Resistant 13A-G অভিহিত করা হয়। তার পরও বহুকাল অপেক্ষা করতে হয় এই গুণটিকে ব্যবহার করে আধুনিক একটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে। অবশেষে জৈবপ্রযুক্তি সহজ করে দেয় সে পথ। একসময় জলমগ্ন, সহনশীল আসল জিনটাকে শনাক্ত না করা গেলেও অন্তত জানা যায় কোন ক্রোমোজমের কোথায় এই জিনটি আছে। এই অংশটুকুকে Quantitative trait locii (QTL-Sub1) হিসেবে শনাক্ত করে জাত উদ্ভাবনের কাজ চলতে থাকে। একসময় ইরি (আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট), ভারত-বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় বেশ কিছু কৌলিক সারি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। তবে জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে পোষক জাত হিসেবে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত জনপ্রিয় জাতগুলোকেই এত দিন প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন পূর্ব ভারতে জনপ্রিয় স্বর্ণা এবং বাংলাদেশে জনপ্রিয় বিআর-১১ ধান ব্যবহার করে দুটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ দুটি জাতকে একসময় গবেষণাগারে স্বর্ণা ঝঁন১এবং বিআর-১১ ঝঁন১ (Nick-name) বলে অভিহিত করা হতো। পরে সরকারিভাবে যথাক্রমে ব্রি ধান৫১ এবং ব্রি ধান৫২ নামে জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়।
তবে জাত দুটি যে চাষিদের মনের মতো হয়েছে তা বলা যাবে না। আমি বলি মন্দের ভালো। যেখানে কোনো ধানের জাতই এক সময় টিকে থাকতে পারত না, সেখানে এই জাতগুলো কিছুটা হলেও টিকে থাকতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের জমির পরিমাণ এক থেকে আড়াই লাখ মিলিয়ন হেক্টরের মতো। এ হিসাবটা এমন হওয়ার কারণ হলো বছরগুণে বর্ষার প্রকৃতি ভিন্ন হওয়ায় এ ধরনের জমির পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। এই অবস্থায় হেক্টর পিছু এক টন করে ফলন বাড়াতে পারলেও অনূ্যন এক মিলিয়ন টন ধানের সংস্থান করা যাবে। তাই এ ধান নিয়ে বিজ্ঞানীদের অর্জনকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তারপরও আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। আমরা আরো বেশি করে বন্যার ধকল সইতে পারে এ ধরনের জাত চাই। এবার খরার কথা কিছু বলি। খরা নিয়ে এখনো ভালো কিছু করা যায়নি। খরার প্রকৃতিও বোঝা দুঃসাধ্য। অধিকাংশ সময়ে খরাকে কোনো প্রকার গাণিতিক মডেলে বাঁধা কষ্টকর বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। তবুও রোপা আমনের জন্য কিছুটা জানা গেছে বলা যায়। যেমন মৌসুমের শুরুতে খরা হতে পারে, আবার হয়তো শেষের দিকে। (বলে রাখা ভালো আগে কিন্তু রোপা আমনের শুরুতে তেমন খরা দেখা যেত বলে শোনা যায়নি। কারণ সময়টা আষাঢ়-শ্রাবণ)। আমাদের সেচ প্রকৌশলীরা তাই রোপা আমন ধানকে আর বৃষ্টিনির্ভর বলতে চাইছেন না। তাঁরা বলছেন, বৃষ্টির ভরসায় বসে থাকলে এখন ফসল মারা পড়তে পারে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে, কিন্তু সমস্যা হলো বৃষ্টি না থাকলে নদী-নালায়ও তো পানি থাকে না। অতএব বৃষ্টির পানি কিভাবে ধরে রাখা যায় সেটাই এখন জরুরি বিবেচ্য বিষয়। অতি সম্প্রতি ব্রি থেকে সুপারিশকৃত দুটো জাত (ব্রি ধান৫৬ এবং ব্রি ধান৫৭) অবমুক্ত করা হলো। এই জাত দুটি স্বল্প জীবনকালের বলে মৌসুমের শেষের খরাকে পরিহার করতে পারবে। এ দুটি জাতের একটির ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে জাতটি কিছুটা হলেও সরাসরি খরা সইতে পারে। যাহোক, মাঠে গেলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে চাষিপর্যায়ে ব্রি ধান৫৬ ভালো করার কথা শোনা গেছে। ভারতে এবং নেপালেও নাকি ভালো করেছে। যাহোক, আমরা ভালোর অপেক্ষায় থাকব। তবে খারাপ করলেই ধৈর্য হারানো ঠিক হবে না। খরা নিয়ে সবে তো আমাদের যাত্রা শুরু। এগুলো আরো অনেক গবেষণা করার দরকার আছে। যাহোক, সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের বলি, এই জাতগুলোর যদি কিছু খারাপ গুণ থাকে, সেগুলোও আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া ভালো। যেমন পরিস্থিতি সাপেক্ষে রোগবালাই হতে পারে। সে ব্যাপারে চাষিরা যাতে সময়মতো সতর্ক ভূমিকা রাখতে পারেন।
এখন আমরা সবাই বিশ্বাস করি পরিবেশের অবশ্যই কিছু একটা পরিবর্তন চলছে। তাই এই বৃষ্টির দোলাচল চলতেই থাকবে। আমাদের সঙ্গে হয়তো আরো নতুন অনেক কিছুর দেখা হবে। তার জন্যও আমাদের প্রস্তুতির দরকার আছে।

লেখক: মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।

No comments

Powered by Blogger.