এই দিনে-কুষ্ঠজনে পর ভেবো না

আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিভিন্ন দেশে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবারে বাংলাদেশে এই দিবসটি পালনের বাড়তি তাৎপর্য হলো আমাদের সংসদ গত নভেম্বর মাসে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে ‘দ্য লেপার্স অ্যাক্ট ১৮৯৮’ নামে পুরোনো আইনটি বাতিল করেছে। ফলে আইনগতভাবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সোপান উন্মোচিত হয়েছে।


অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ওই আইনে অসহায়, হতদরিদ্র কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা রাখা হতো। ফলে তাঁদের সব ধরনের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো।
উল্লেখ্য, ওই আইনটি যখন রচিত হয় তখনকার অবস্থা থেকে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক আগেই বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে পৃথিবীর সর্বত্র বিনা মূল্যে কুষ্ঠ রোগের সফল চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সর্বাধুনিক সফল চিকিৎসা এমডিটি বা মাল্টি ড্রাগ থেরাপি রোগের মাত্রাভেদে নির্দিষ্ট মেয়াদে সেবন করলে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। দুঃখের বিষয়, আজও আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার-পরিজন এবং আগে কুষ্ঠ ছিল এমন সব ব্যক্তির সমাজে স্থান করে নেওয়া বড়ই কঠিন। এখনো অনেকেই কুষ্ঠ রোগীদের বিষয়ে পুরোনো সংস্কারজনিত ‘অস্পৃশ্যতার’ মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তাই কুষ্ঠ আজও একটি সামাজিক সমস্যা। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণা, উদাসীনতা ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত মানুষ ও তাঁদের পরিবারের লোকজন অনেক দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার শিকার হয়ে জীবনকে বোঝাস্বরূপ মেনে নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকেন। তাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধিতার চেয়ে বেশি বড় প্রতিবন্ধিতা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। যাঁদের কুষ্ঠ হয়, তাঁদের প্রতি বিরাজমান অস্পৃশ্যতার কারণে তাঁদের নিজেদের মধ্যেও তৈরি হয় এক আত্মধিক্কার। এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি।
সচেতনতার অভাবে ও সময়মতো ওষুধ না খাওয়ার ফলে কুষ্ঠের কারণে দেশে বর্তমানে ৩৫ হাজারের মতো কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘা ও বিভিন্ন ধরন এবং মাত্রায় প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়ে আছেন। কুষ্ঠ রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবচেয়ে মৌলিক প্রয়োজন হচ্ছে: এক. জনগণকে যথেষ্ট সচেতন করা, যাতে কারও রোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন তা জানতে পারেন এবং দুই. এমডিটি যেন রোগী ব্যবহার করেন, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পৃথিবীর সর্বত্রই কুষ্ঠ রোগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সফল চিকিৎসা হচ্ছে এই এমডিটি, যা বিনা মূল্যে হু (who) সরবরাহ করে এবং সব রোগীকে দেওয়া হয়ে থাকে।
কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে নিচের বিষয়গুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
১. বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি বাস্তবসম্মতভাবে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। এই লক্ষ্যে দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে এবং নার্সিং শিক্ষায় কারিকুলাম কুষ্ঠ রোগ ও তার চিকিৎসা বিষয়ে যথেষ্ট প্রয়োগিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
২. অন্ততপক্ষে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কুষ্ঠ রোগের বিষয়ে মৌলিক শিক্ষাদানের জন্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বা সাধারণ বিজ্ঞানের বিষয়ে যথাবিহিত অন্তর্ভুক্তি থাকা আবশ্যক।
৩. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন সংবাদ ও কুষ্ঠ বিষয়ে সাফল্যমূলক তথ্য ও খবরাখবর পরিবেশন করা আবশ্যক। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও লেপ্রসি মিশনের বিভিন্ন প্রকল্পসহ কুষ্ঠ রোগের জন্য কাজ করে এমন সব সংস্থায় এ রোগের চিকিৎসা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়।
বিখ্যাত বেহালাবাদক ইসহাক পার্লম্যানের কথা বলে আমার লেখা শেষ করতে চাই। পার্লম্যান ১২ বছর বয়সে পোলিও রোগের ফলে প্রতিবন্ধী হয়ে যান। সারাজীবন তাঁকে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। একবার যখন কোনো একটা কনসার্টে তিনি একটা কঠিন সুর বাজাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বেহালার চারটি তারের একটা ছিঁড়ে যায়। তার শব্দে কনসার্টের অন্য সব বাদক বাজনা থামিয়ে দেন। সবাই ভাবলেন, তিনি হয়তো খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাশের ঘরে গিয়ে তাঁর বেহালার ছিন্ন তারটি বদল করে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি ইশারায় সবাইকে বললেন, ‘আমরা থামব না, বাজনা চালিয়ে যাব।’ গভীর আত্মবিশ্ব্বাস ও নিপুণ দক্ষতায় নিখুঁতভাবে সেদিন তিনি কনসার্টের বাকি অংশ বাজিয়েছিলেন। তন্ময় হয়ে সব শ্রোতা সেদিন সেই কনসার্ট উপভোগ করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে শ্রোতারা অনেকে এসে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, তিনি কীভাবে অমন সুন্দর বাজনা পরিবেশন করেছিলেন? পার্লম্যান উত্তরে বললেন, ‘সারা জীবন একটা লক্ষ্য নিয়ে আমি চলেছি: আমার যা আছে তা নিয়েই গান বাজানো।’
কুষ্ঠ রোগ কিংবা অন্যান্য কারণে জীবন যাঁদের বিধ্বস্ত এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার কারণে মানবাধিকার বঞ্চিত, আমাদের সবচেয়ে বড় মিশন বা লক্ষ্য তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো; যেন তাঁদের জন্য আমরা এমন পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা দিতে পারি; যেখানে তাঁরা মর্যাদা নিয়ে অন্য সব মানুষের মতোই বাঁচতে, তাঁদের যা আছে তা নিয়েই তাঁরা জীবনের জয়গান গাইতে পারেন। জীবনবীণার কোনো তার ছিঁড়ে গেলেও সমাজের জন্য মানুষের মতো তাঁদের বাঁচার স্বপ্ন তাঁরা দেখতে পারবেন।
রেভা মার্টিন অধিকারী

No comments

Powered by Blogger.