ভারত-বাংলাদেশ আরও কাছাকাছি

অবশেষে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় প্রতিবেশী আক্ষরিক অর্থেই যোগাযোগের নতুন অধ্যায়ের সূচনালগ্নে এসে পৌঁছেছে। ফলে উভয় দেশই লাভবান হতে চলেছে। বাংলাদেশ যেমন পরিবহনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধা লাভ করছে। উভয় দেশেরই সামনে খুলে গেছে উইন-উইন কন্ডিশনে থেকে বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় করার সুযোগ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই পথেই হাঁটছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হতে চলেছে। আগরতলা থেকে আখাউড়া রেলপথ নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যেই উভয় দেশের রেলমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। মোট ১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হলেই আখাউড়া ও আগরতলার রেল-সংযোগ স্থাপিত হবে। এর মধ্যে ভারতে ৫ কিলোমিটার ও বাংলাদেশে ১০ কিলোমিটার রেলপথ। ভারত সরকার পুরো রেলপথ বানানোর খরচই বহন করছে। ২০১৭ সালের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ করার বিষয়ে উভয় রাষ্ট্রই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই রেল-সংযোগ স্থাপিত হলে পণ্য পরিবহনের ইতিহাসে বাংলাদেশের নতুন দরজা খুলে যাবে। শুধু আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যই নয়, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েও বহু অর্থ আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজেও বাংলাদেশের বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। সড়ক পরিবহন উপকৃত হবে। ভারতও দুর্গম উত্তর–পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে সহজে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে পারবে। আসলে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন সবচেয়ে সহজ পথ। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে কলকাতার প্রচলিত পথে দূরত্ব ১৬৫০ কিলোমিটার। ত্রিপুরা থেকে আসাম, মেঘালয়, ফের আসাম, বিহার হয়ে যেতে হয় কলকাতা। কিন্তু ঢাকা হয়ে কলকাতা যেতে পেরোতে হয় মাত্র ৬২০ কিলোমিটার পথ। এটাই হলো বাস্তবতা। তাই ত্রিপুরা সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলে এসেছে। আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৫৭ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার। সব দিক বিবেচনা করেই ত্রিপুরা বাংলাদেশের বন্দরের সুবিধা নিতে উৎসাহী। বাংলাদেশ সরকারও মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার অবদান এবং নিজেদের স্বার্থ মাথায় রেখেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। ২০১২ সালে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য মালামাল আনতে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতের হায়দরাবাদ থেকে ত্রিপুরায় চাল আনার ক্ষেত্রেও আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহৃত হয়। চলতি বছরেও ২৩৫০ টন চাল আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছাচ্ছে।
এই বিপুল পরিমাণ চাল পৌঁছাতেও আশুগঞ্জের স্থানীয় পরিবহন ও শ্রমিকেরা ব্যবহৃত হচ্ছেন। চালের পাশাপাশি রডও পৌঁছাচ্ছে একই পথে। উভয়ের জন্যই লাভজনক হচ্ছে এই পরিবহন। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পেট্রোলিয়াম সামগ্রীও নিয়ে যাচ্ছে ভারত। ভারতের আসামের বঙ্গাইগাঁও থেকে মেঘালয়ের ডাউকি, বাংলাদেশের তামাবিল থেকে চাতলাপুর হয়ে উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশহর পৌঁছাতে শুরু করেছে পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ও এলপিজি। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রুট চালু থাকবে। এই রুটে বাংলাদেশ রাজি না থাকলে ভারতকে এই বর্ষার মৌসুমে ৪০০ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে জ্বালানি আনতে হতো। বাংলাদেশ এই রুট খুলে দেওয়ায় ভারত লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশও পণ্য পরিবহন শুল্ক ছাড়াও পরোক্ষে লাভবান হচ্ছে পরিবহন শিল্পের উন্নয়নে। উভয় দেশই যোগাযোগের উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভারত রেল পরিকাঠামোর পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগ বাড়াতে পরিবহন পরিকাঠামো গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রামগড় মহামুণির সঙ্গে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের আনন্দপাড়ার নবীনপুরের সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হতে চলেছে। ফেনী নদীর ওপর ৪১২ মিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণের জন্য ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ পর্বও প্রায় শেষ। ২০১৭ সালের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা।
মূল সেতুটি অবশ্য ১৫০ মিটারের। বাকিটি অ্যাপ্রোচ রোডের জন্য নির্মিত হবে। সেতুটি নির্মিত হলে ত্রিপুরার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার আরও সহজ হবে। সাব্রুম অবধি রেলপথ নির্মাণপ্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই হাতে নিয়েছে ভারতীয় রেল। তার কাজও ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা। রেল ও সেতু উভয় নির্মাণকাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের পূর্বমুখী নীতি বা ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ বাস্তবায়নের বড় দরজা খুলে যাবে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনশিল্পেরও। আকাশপথেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়তে চলেছে। ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা বলেছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল শুরু করার বিষয়টি তাঁর মন্ত্রণালয় বিবেচনা করছে। চেষ্টা চলছে উভয় দেশে বহমান নদীগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে নৌপরিবহনের উন্নতি সাধন। এর জন্য ইতিমধ্যেই ভারত সরকার অর্থ বরাদ্দ করেছে। ইতিমধ্যেই তারের বন্ধনে আবদ্ধ ভারত ও বাংলাদেশ। চলতি বছরেরই ২৩ মার্চ উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে উদ্বোধন করলেন ইন্টারন্যাশনাল কেব্‌ল নেটওয়ার্কের। 
কক্সবাজার থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট   ব্যান্ডউইটথ ভারতকে রপ্তানি করছে। এর জন্য মাত্র ৩০ কিলোমিটার কেবল পাততে হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট রাজ্যটি এই সুবিধা পেয়ে এখন ইন্টারনেটের গেটওয়ে হয়ে উঠেছে। অনেক বহুজাতিক সংস্থা ত্রিপুরায় আইটি হাব করতে চাইছে। বাংলাদেশও এই সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে পাচ্ছে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা। একই দিনে উভয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ত্রিপুরার পালাটানা থেকে বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানিও শুরু হয়। স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রেও সেই উইন-উইন ফর্মুলা। কথায় বলে, যোগাযোগ বাড়লে মনোযোগ বাড়ে। বাসযাত্রা দিয়ে শুরু। এখন ভারত–বাংলাদেশ রেল, নৌ, সড়ক ও আকাশ পরিবহনে সমান আগ্রহী। কারণ উভয় রাষ্ট্রই বুঝতে পারছে, এটাই সময়ের প্রয়োজন। ভিসা পদ্ধতি সহজ করার বিষয়েও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে। ব্যবসায়িক যোগাযোগের পাশাপাশি মানুষে মানুষে যোগাযোগও বাড়ছে। এই যোগাযোগ বৃদ্ধিই পারে আগামী দিনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে। উভয় রাষ্ট্রের উন্নয়নে এটাও বড় জরুরি।
তরুণ চক্রবর্তী:প্রথম আলোর ত্রিপুরা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.