রায় লেখা নিয়ে বিতর্কের নতুন মাত্রা

অবসরে গিয়ে রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি- এই মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ৫২ বছর আগে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ. আর কর্নেলিয়াসের দেয়া রায়ের প্রতিধ্বনি করেছেন। কাজী মেহের দীন বনাম মিসেস মুরাদ বেগম মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, অবসরে গিয়ে রায় লেখা যাবে না। প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান ইতিপূর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৬ ডিএলআর, ৩৯২ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ওই রায়ের বরাতে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবসর জীবনে দেয়া রায়কে অযথাযথ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ওই রায়ে একজন বিচারপতি অবসরে গিয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। আর তিনি একটি আপিল মামলায় রায় দিয়ে অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেন এবং তাতে সই দেন। সাবেক বিচারপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরী প্রধান বিচারপতি সিনহার মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করে বলেছেন, অবসরে গিয়ে বিচারকরা রায় দেন না। তারা শুধু ঘোষিত রায়ের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে রায় লেখেন। বিচারপতি আমিরুল নিজেও এরকম রায় লিখেছেন।
পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, রায় লেখা একটি বিচারিক কর্ম বা জুডিশিয়াল ওয়ার্ক। কোনো বিচারক অবসরে গেলে আর বিচারক থাকেন না। তাই অবসরে রায় লেখা বৈধ নয়। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট এ প্রসঙ্গে দেওয়ানি কার্যবিধি সিপিসির অর্ডার ২২ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, সিপিসি অবসর পরবর্তী রায় প্রদানকে সমর্থন করে না। কারণ একজন বিচারক অবসরে গেলে তিনি ফাংটাস অফিসিও হয়ে যান। লাতিন আইনি পরিভাষা অনুযায়ী ফাংটাস অফিসিও মানে তিনি আর অফিসে থাকেন না। তাই অফিসে থাকার যে এখতিয়ার সেটা তিনি হারিয়ে ফেলেন।
অনেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মনে করেন প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে কেবল ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতার পক্ষে বিপক্ষের রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার দিক থেকে দেখা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও বিচার বিভাগের প্রস্তাবিত সংস্কারের জন্য ক্ষতিকর। কারণ অনেক অভিজ্ঞ আইনবিদ জোর দিয়ে বলেছেন, এখন উচিত হবে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের আলোকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রুলসে উপযুক্ত সংশোধনী আনা। যাতে কোনো কর্মরত বিচারক অবসরে যাওয়ার আগের মাসগুলোতে বিপুল সংখ্যক মামলার রায়দানকারী হিসেবে গণ্য হতে না পারেন।   
উল্লেখ্য, সাধারণভাবে অন্যান্য দেশের সুপ্রিমকোর্টের দেয়া রায়কে উপমহাদেশের সুপ্রিম কোর্টগুলো মান্য করে থাকেন। একই ধরনের পরিস্থিতিতে তারা এসব মামলার সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। আইনবিদরা বলছেন, ১৯৬৪ সালের ২৮ এপ্রিলের ওই রায় গত ৫২ বছরের ইতিহাসে কখনও উল্টে যায়নি। সুতরাং ওই মামলার রায়ের একটি পার্জুয়েজিব ভ্যালু বা বোধযোগ্য মূল্য রয়েছে।
এ ছাড়া ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারকগণও অবসরে গিয়ে রায় লেখেন না। যদিও সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ দাবি করেছেন যে, ভারত ও ইংল্যান্ডের বিচারকরা অবসের গিয়ে রায় লিখে থাকেন।
তবে ওয়াকেবহাল মহল বলেছে, অবসরে গিয়ে রায় লেখার চেয়েও বিলম্বে রায় লেখা একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এমনকি হত্যা মামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে বিচারপ্রার্থীদের ৩/৪ বছরও অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আগে বছরের পর বছর পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিএনপি জোট সরকারের আইনমন্ত্রী থাকতেই এই সমস্যার বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন। প্রকাশ্য আদালতের রায় বা আদেশ একজন বিচারক ১৫০টির বেশি মামলার রায় না লিখে অবসরে যাওয়ার এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। অবসর গ্রহণের পরে রায় প্রদানের বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সাম্প্রতিক মন্তব্য ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে কিনা সে বিষয়ে ওয়াকেবহাল মহলে জল্পনাকল্পনা দেখা দিয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রধান বিচারপতির মন্তব্য ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে’ বলে মন্তব্য করেছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলেন, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য কেন্দ্র করে গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইনবিদরা এক আইনি বিতর্কে সামিল হয়েছেন। কিন্তু বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে বেশি দেখা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি মনে করেন অবসর গ্রহণের পরে রায় লেখা সংবিধানের পরিপন্থি। কারণ অবসরে গেলে বিচারকদের শপথ থাকে না, তারা সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন। তাঁর এই মতামতকে লুফে নিয়েছেন বিএনপি সমর্থক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা, কারণ তারা প্রধান বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে এখন নতুন করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের বৈধতার প্রশ্ন সামনে এনেছেন।
উলেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে রায় প্রদান করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাঁর অবসরে যাওয়ার এক বছরের বেশি সময় পরে মূল রায় লিখেছিলেন। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অনেক আইনবিদ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন,  অবসরে গিয়ে রায় লেখা বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটা দীর্ঘকালীন রেওয়াজ। তাদের যুক্তি অবসরের আগেই তারা রায় দেন। কিন্তু লেখেন পরে। এ প্রসঙ্গে তারা বহুল আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের উল্লেখ করছেন, যা অবসরে গিয়ে লিখেছিলেন প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধানে যদি লেখা থাকতো অবসরে গিয়ে কেউ রায় লিখতে পারবেন না তাহলে সেটা অসাংবিধানিক হতো। এ কারণে অসাংবিধানিক বলা যাবে না বে-আইনিও বলা যাবে না। তাই প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আইনি বা সংবিধানের দিক থেকে ঠিক নয়।

No comments

Powered by Blogger.