দ্বিদলীয় বৃত্তে বন্দী ভারত, বিকল্প কে? by কুলদীপ নায়ার

নরেন্দ্র মোদি ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যেসব উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেগুলো যদি পূরণ হয়, তাহলে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে যাবে৷ এ কর্মসূচি দিয়েই বিজেপি ২৮২টি আসন পেয়েছে৷ মোদির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷ দলের নির্বাচিত সাংসদদের উদ্দেশে তিনি খুব আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য দিয়েছেন৷ তাঁর কণ্ঠের প্রত্যয় দেখে মনে হচ্ছে, তিনি অন্তত এক দশক ক্ষমতায় থাকার সংকল্প করেছেন৷ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান হলে নিকট ভবিষ্যতে কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা আরও কঠিন হয়ে উঠবে৷

বিজেপি-আরএসএস জুটি দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে সফলতা পাওয়ায় হিন্দুত্বের ঘুঁটিটি বের করার তেমন একটা দরকার হবে না, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি মোদির ঘটে আছে৷ মধ্যবিত্ত নমনীয় হিন্দুত্বের কর্মসূচি খেয়েছে, তা না হলে এরূপ ভূমিধস বিজয় মোদির বিজেপির কপালে জুটত না৷ সে কারণেই মোদি উন্নয়নের ওপর জোরারোপ করছেন৷ তিনি দেখাতে চান, বিজেপি ভারতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে দারিদ্র্যের জোয়াল থেকে মুক্ত করতে পারে৷
যদিও কংগ্রেসের এই ভরাডুবি এবারই নতুন নয়, লোকসভায় দলটি এবার ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪৪টি পেয়েছে৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর দলটির এরূপ ভরাডুবি হয়েছিল৷ জরুরি অবস্থার রূপকার ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর ছেলে সঞ্জয় গান্ধীও সেই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন৷ সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে সংবিধান, আইন, কোনো কিছুই প্রযোজ্য ছিল না৷ তার পরও দক্ষিণের রাজ্যগুলো যেমন: কেরালা, কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশ কংগ্রেসেরই ছিল৷ সেবার কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ছিল ১৫০৷ এটা ছিল পরাজয়, তবে এবারের মতো তা বিপর্যয়কর ছিল না৷
সেবার জরুরি অবস্থার সময় কংগ্রেস যে বাড়াবাড়ি করেছিল, জনগণ তার জন্য দলটিকে শাস্তি দিয়েছিল৷ জনগণ এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল৷ তারপর জনতা পার্টি ক্ষমতায় এসে লেজে গোবরে করে ফেললে মানুষ আবার কংগ্রেসের ওপর আস্থা রাখে৷
এবার জনগণ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে দলটির অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে৷ কংগ্রেস যেন এবার দুর্নীতির ঝাঁপি খুলে বসেছিল, একটার পর একটা শুধু বেরিয়েছে৷ দলটির প্রতি জনগণের এবারের অভক্তি আরও গভীর৷ তারা যে সুশাসন ও দক্ষ সরকার ব্যবস্থাপনা একেবারেই নিশ্চিত করতে পারবে না, সে বিষয়ে জনগণ একদম নিশ্চিত৷
এটা ঠিক, মনমোহন সিং ছিলেন একদম খোলা বইয়ের মতো৷ কিন্তু তাঁর কার্য সম্পাদনের পাতা শূন্য৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ক্ষমতার দাপটে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও মার খেয়ে যায়৷ মনমোহন সিং কখনোই কংগ্রেসের সমস্যা ছিলেন না৷ দলটি কীভাবে পরিবারতন্ত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, সেটাই আজ দেখার বিষয়৷
পার্টির সভাপতি সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধী সরকার ও দল চালিয়েছেন৷ এখন দুজনেই ব্যর্থ হওয়ায় জনগণ কার দিকে মুখ তুলে তাকাবে? দুজনেই পদত্যাগ করার কথা বলেছেন, কার্যকরী পরিষদ সেটা নাকচ করে দিয়েছে৷ যা-ই হোক, তাঁরাই হচ্ছেন নেতা৷ তাঁরা কাউকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেননি৷ সে কারণে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারেনি৷
জওহরলাল নেহরু সম্বন্ধে বলা হতো, তিনি হচ্ছেন বটবৃক্ষের মতো, যে গাছের ছায়ায় অন্য কোনো গাছ জন্মাতে পারে না৷ কংগ্রেস তাঁর ওপর নির্ভরশীল ছিল৷ সে কারণে তাঁর মৃত্যুর পর দলের ভেতর থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অন্য কোনো নেতা উঠে আসেননি৷ তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি নিজ হাতে গড়ে তুললেও দলের ভেতরে তিনি তখন গ্রহণযোগ্য ছিলেন না৷ নেহরুর পর দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর উত্তরসূরি হওয়ার কথা৷ তবে মোরারজি দেশাইও সেই চেষ্টা করেছিলেন, কারণ অধিকাংশ মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি৷ কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি কে. কামারাজ তাঁকে খুব গোঁড়া হিসেবে আখ্যা দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকেই বেছে নিলেন৷
আজ কংগ্রেস একদমই ভিন্ন, কারণ কে. কামারাজ ও মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এক ব্যক্তির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন—সোনিয়া গান্ধী৷ দলকে কিছু ভাবতে হবে না৷ তাঁকে ভেবে দেখতে হবে৷ তিনি কি দল, রাজ্য নেতা ও অন্যদের ওপর
তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে চান? তৃণমূলে কাজ করাকে কি তিনি গুরুত্ব দেবেন, নাকি চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবেন? দলের বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হবে, এ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব আছে৷ এ রকম কিছু একটা চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু জাল ভোটারদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা নিছক এক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে৷
হয়তো দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একাকার করে ফেলা উচিত৷ মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও এ কাজ করেছিলেন৷ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দলীয় সভাপতিকে তাঁর পাশে পেয়েছিলেন৷ এটা অনেকাংশে রাষ্ট্রপতি–শাসিত সরকারব্যবস্থার সমান৷ নরেন্দ্র মোদিও এভাবেই সরকার চালাবেন৷ তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় এর আভাস পাওয়া গেছে৷ রাষ্ট্রপতি–শাসিত সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সেখানে কর্তৃত্বপরায়ণতার সুযোগ থেকে যায়৷ মোদি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সেরও নেতা হবেন তিনি৷
ইতিহাসে এরূপ নজির ভূরি ভূরি আছে৷ সোভিয়েত ইউনিয়নও এভাবে চলেছে৷ কয়েক দশক পরে মস্কোর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে৷ এমনকি রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও একইভাবে দেশ চালাচ্ছেন, ইউক্রেনের প্রতি মস্কোর মনোভাবে এর প্রতিফলন দেখা গেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা থাকলেও সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য আছে, সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র একনায়কতন্ত্র পরিহার করতে পেরেছে৷ মার্কিন সংসদে কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী৷
ভারতে কংগ্রেস আবারও ফিরে আসতে পারে, কারণ এ দলই ভারতে এখন একমাত্র বিকল্প৷ জনগণের মনে দুটি দলই আছে—কংগ্রেস ও বিজেপি৷ এক দল ব্যর্থ হলে মানুষ আর কোনো বিকল্প না পেয়ে অপর দলকেই বেছে নেয়৷ ভারতের জনগণ এ দুই দলের মধ্যে আটকা পড়েছে৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন আম আদমি পার্টিতে পরিণত হয়েছে৷ দলটি নিজেদের ভিত্তি বড় করতে পারলে বিকল্প হয়ে উঠতে পারে৷ তারা এই িনর্বাচনে ৩ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছে৷ তবে এরা যে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়৷ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে হলে দলটির আদর্শ ও লক্ষ্য থাকতে হবে৷ দলটি দিল্লিতে যে সুযোগ পেয়েছিল, সেটি তারা নষ্ট করেছে৷ শেষ পর্যন্ত দলটি অনেক দেরিতে নিজেদের ভুল স্বীকার করলেও গায়ের কালিমা দূর করতে অনেক সময় লাগবে৷ দলটিকে মাঠে কাজ করতে হবে৷ শুধু স্লোগানের ওপর নির্ভর করে দলটি চলতে পারবে না৷ দলটির ওপরের দিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, বিশেষত এর নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হাতে৷ এর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷ সেটা হলে মোদির জন্যও ভালো হবে৷
ইংরেজি থেকে অনূদিত
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.