‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায় মামলা ‘খুন’ আর কত?

প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি পড়ে হতবাক হওয়ারই কথা। একসঙ্গে ৯৮টি আলোচিত মামলা ও মামলা থেকে আসামির নাম প্রত্যাহারের সুপারিশ! তার মধ্যে ৪০টি আবার মৃত্যুদণ্ডযোগ্য খুনের মামলা। আছে ধর্ষণ, ঘুষ লেনদেন, অবৈধভাবে সরকারি টাকা আত্মসাৎ, ডাকাতি, অবৈধভাবে অস্ত্র দখলে রাখা, কালোবাজারি, অপহরণ, জালিয়াতি, বামা, চুরি, অস্ত্র মামলাসহ যত গুরুতর অপরাধের মামলা। তাতে রেহাই পেতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী মাছ কাদেরসহ অর্ধশতাধিকের বেশি আসামি। এ নিয়ে গত মহাজোট সরকারের আমলে সাত হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সুপারিশের ঘটনা ঘটল (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। তবে এই ‘প্রত্যাহার’ ‘প্রত্যাহার’ খেলাটা নতুন নয়। এক সরকারের আমলে যা ‘হত্যা মামলা’, অন্য সরকারের আমলে তা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ মামলা। ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনা’য় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের ২০০১-০৬ মেয়াদে পাঁচ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু আসামিকে অব্যাহতি দেয়।
এ প্রক্রিয়ায় তখন মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন অভিযুক্ত খালাস পায়। (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১৩)। এ রাজনৈতিক খেলার অস্ত্র ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারা। ‘মামলা পরিচালনা প্রত্যাহারের ফল’ শিরোনামের ধারাটির মূল ভাষ্য হচ্ছে—রায় ঘোষণার আগে, আদালতের অনুমতি নিয়ে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কোনো মামলা সম্পূর্ণ কিংবা তাতে বর্ণিত এক বা একাধিক অপরাধের অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারেন। ওই প্রত্যাহার অভিযোগ বা চার্জ গঠনের আগে অনুমোদিত হলে অভিযুক্তকে ডিসচার্জ করতে হবে। আর চার্জ গঠনের পরে অনুমোদিত হলে বা আইনানুসারে চার্জ গঠনের দরকার না হলে অভিযুক্তকে খালাস দিতে হবে। মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশগুলো মূলত এই ধারাবলে পিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।তবে বরাবরই প্রয়োগের চেয়ে ধারাটির অপপ্রয়োগ বেশি। আইনগত ব্যবহারের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যবহার বেশি। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই ধারাটি নিজেই। ধারাটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ অস্পষ্টতায় দুষ্ট:
১. ঠিক কোন কারণে বা কিসের ভিত্তিতে বা কী উদ্দেশ্য বা পরিস্থিতিতে একজন পিপি বা সরকারি কৌঁসুলি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন, সে বিষয়ে ওই ধারায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
২. আদালত কখন, কী বিবেচনায়, কিসের ভিত্তিতে ওই প্রত্যাহার আবেদনে মঞ্জুর করবেন বা করবেন না, তা-ও ওই ধারায় বলা নেই। তবে ভারত, পাকিস্তানসহ আমাদের উচ্চ আদালতের রায়ে ওই অস্পষ্টতাগুলো অনেকটাই সুস্পষ্ট। ওই সব রায়ের ভিত্তিতেই বিষয়গুলো পরিষ্কার করছি। প্রত্যাহার আবেদনের উদ্দেশ্য ও ভিত্তি: একটি মামলার ভিত্তি সব সময় মজবুত হয় না। কখনো কখনো তা হয় খুবই দুর্বল, খেলো। অভিযোগ গঠনের পর কখনো দেখা যায়, আনীত অভিযোগ যুক্তিহীন এবং ভিত্তিহীন। কখনো আবার সাক্ষ্য এতই অপ্রতুল যে, তাতে অভিযুক্তের শাস্তি হওয়ার নয় বা মামলাটা প্রমাণের মতো পর্যাপ্ত সাক্ষীই পাওয়া যাচ্ছে না, এককথায় যাকে বলে মামলাটা প্রমাণ-অযোগ্য। কিংবা কখনো দেখা যায় মামলাটি প্রাথমিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত নয় (prima facie case নেই)। ওই রকম পরিস্থিতিতেই সংশ্লিষ্ট সরকারি কৌঁসুলি আদালতের কাছে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন করবেন। মূলত তুচ্ছ, অযাচিত বা মিথ্যা মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সময় বাঁচাতে এবং নিরীহ-অসহায় মানুষকে হয়রানিমূলক মামলা থেকে মুক্তি দিতে ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলা প্রত্যাহারের বিধানসংবলিত ওই ৪৯৪ ধারা সংযোজিত হয়। সরকারি কৌঁসুলির বিবেচনা: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশসংবলিত চিঠি হাতে পাওয়ার পর আমাদের দেশের সরকারি কৌঁসুলিরা সাধারণত এ সম্পর্কে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সরাসরি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে তৎপর হয়। মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিই যেন বাধ্যবাধকতার বাহক। অথচ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলছেন ভিন্ন কথা, ‘সরকার সরকারি কৌঁসুলিকে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ বা পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু তজ্জন্য কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে না।
সরকারি কৌঁসুলিরা আদালতের কর্মকর্তা এবং আদালতের কাছেই দায়বদ্ধ’ (্সুবাস চন্দর বনাম রাষ্ট্র, এআইআর ১৯৮০ সুপ্রিম কোর্ট ৪২৩)। আদালতের সম্মতি: ৪৯৪ ধারাবলে আদালতের নিজ উদ্যোগে বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। কিন্তু তাহলেও ওই প্রত্যাহারের পূর্বশর্ত হলো আদালতের সম্মতি। ওই সম্মতি হবে আবার অবাধ। কোনো রকম চাপ ছাড়াই আদালত তা প্রয়োগ করবেন (২৮ ডিএলআর ৩৮৬)। এ ক্ষেত্রে আদালত অবশ্যই তাঁর বিচারগত স্বেচ্ছাধিকার প্রয়োগ করবেন এবং আইনানুসারে কাজ করবেন (৩৮ ডিএলআর ২৮২)। আদালতের সম্মতি ছাড়া এই ধারাবলে মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই এবং তা প্রদানে আদালত কোনোভাবে বাধ্যও নন (এআইআর ১৯৪৯ পাট. ২২২, ২২৭)। মামলা প্রত্যাহারে আদালতের বিবেচনা: মামলা প্রত্যাহারের আদেশ একটি বিচার বিভাগীয় আদেশ। তাই সেটি ইচ্ছামাফিক হবে না এবং শক্তিশালী কোনো কারণ ছাড়া প্রদত্ত হবে না (২৮ ডিএলআর ৩৮৬)। কেবল পিপির আবেদনের ভিত্তিতে আদালত যান্ত্রিকভাবে কোনো প্রত্যাহারে অনুমোদন দেবেন না (১৯৯৯ এমএলআর ১৮)। এ ক্ষেত্রে মামলার বিষয়বস্তু, অবস্থা এবং অভিযোগের ভিত্তিগুলো সম্ভাব্য সব উপায়ে আদালত খতিয়ে দেখবেন। মামলার নথিপত্র পরীক্ষা করবেন (পিএলডি ১৯৮০ লাহোর ২০১)। তা ছাড়া দেখবেন, জনস্বার্থে ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ওই প্রত্যাহারটা জরুরি কিনা। পাশাপাশি নিশ্চিত হবেন,
প্রত্যাহার আবেদনটি সদ্বিশ্বাসে জননীতির স্বার্থে করা হয়েছে এবং তাতে আইনের স্বাভাবিক পথকে বাধাগ্রস্ত বা ব্যাহত করার কোনো উদ্দেশ্য নেই (এআইআর ১৯৮৭ সুপ্রিম কোর্ট ৮৭৭)। তবে যে মামলা আপস-অযোগ্য নালিশি মামলা কিংবা অভিযুক্ত স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে বা যেখানে কারও বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে অনুমতি দিলে, সে সহযোগী-অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে মর্মে আশঙ্কা থাকে; সেসব ক্ষেত্রে আদালত মামলা প্রত্যাহারে অনুমতি দেবেন না। মামলার বিষয় ও অবস্থা সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কেবল সরকারি কৌঁসুলির পরামর্শে মামলা প্রত্যাহার আইনবহির্ভূত (১২৬ ডিএলআর ১৩৩)। তদুপরি কারণ ব্যতিরেকে মামলার কার্যক্রম প্রত্যাহারের অনুমতি দেওয়া হলে তা একটি বিচারিক কার্যক্রমকে গলা টিপে হত্যা করার শামিল (পিএলডি ১৯৮২ বিজে৯)। এমনকি আদালতের আদেশেও ওই কারণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে প্রয়োজনবোধে হাইকোর্ট ডিভিশন বুঝতে পারেন যে, মামলা প্রত্যাহারের আদেশটি আইনসম্মতভাবে দেওয়া হয়েছে (পিএলডি ১৯৫৯ পেশোয়ার ১৮৬)। উপরোক্ত আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার, ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনার’ নামে যে উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ায় হত্যা মামলাসহ ঢালাওভাবে বিচিত্র ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি আমাদের দেশে বহাল তবিয়তে চলছে, তা কোনোভাবে আইনসংগত নয়। রাষ্ট্রের এ খামখেয়ালিপনা কেবল মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়, এ রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার কিংবা গোটা বিচার-প্রক্রিয়ার প্রতি নির্মম উপহাস। এ অবস্থা নিরসনে ৪৯৪ ধারার সংশোধনীসহ প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
aftabragib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.