৩৪তম বিসিএস ও জনপ্রশাসনের সংকট

মনে হতে পারে, একটি বিসিএস পরীক্ষার ফল ঝুলে থাকলে এমন কী ক্ষতি হয়? শুধু ক্ষতি নয়, আজ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি এর অংশগ্রহণকারীরা। আরও অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছেন ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষা যাঁরা দিতে চান, তাঁরা। তাঁদের পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তিই জারি হয়নি। ৩৪তম বিসিএস মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে এখন ধীর লয়ে চলতে শুরু করেছে। যত চেষ্টাই করা হোক, এটা নিষ্পত্তি করতে বেশ সময় লাগবে। আর এতে চাকরি পাওয়ার কথা প্রায় দুই হাজার জনের। বাকিরা ইতিমধ্যে কোথাও নোঙর ফেলতে না পারলে সরকারি চাকরির বয়সীমাও কারও কারও চলে যেতে পারে। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে তাঁদের ভবিষ্যৎ। ৩৪তম বিসিএসে সমস্যাটি কেন হলো, একটু তলিয়ে দেখার দরকার। বরাবরের মতো গত বছরের ফেব্রুয়ারির সূচনায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। সে বছরের ২৪ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ। ৮ জুলাই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ১২ হাজার ৩৩ জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়। তবে এ পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো চিরাচরিত ঐতিহ্য অবজ্ঞা করে প্রিলিমিনারি পর্যায়েই কোটাপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এ কারণে অনেক কম নম্বর পেয়েও উত্তীর্ণ হন প্রাধিকার কোটার প্রার্থীরা। পক্ষান্তরে, অনেক বেশি নম্বর পেয়েও প্রাধিকারবহির্ভূত প্রার্থীদের বিরাট অংশ উত্তীর্ণ হতে পারেননি সে পর্যায়ে। প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে প্রচলিত পদ্ধতিতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়।
এবারে নাটকীয়ভাবে উত্তীর্ণ ৪৬ হাজার ২৫০ জন। আবার আদিবাসী কোটায় প্রথম দফায় উত্তীর্ণ ২৮০ জন পরবর্তীকালে উত্তীর্ণ না হওয়ায় উচ্চ আদালতে মামলা গড়ায়। আদালত তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পিএসসি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদে দেখা গেল, এ ২৮০ জনকে যুক্ত করে ২৪ মার্চ থেকে লিখিত পরীক্ষা শুরু হবে। অর্থাৎ প্রিলিমিনারির ১০ মাস পর।  বিষয়টি পরিষ্কার যে এত বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ, খাতা দেখাসহ আনুষঙ্গিক কাজ খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এসব দিক বিবেচনায় রেখে একেকটি বিসিএসে নয় থেকে এগারো হাজার প্রার্থীকে প্রিলিমিনারি মেধাতালিকা থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের যোগফল নিয়ে মেধাতালিকা তৈরি হয়। তখন প্রাধিকার ও মেধা কোটা অনুসরণে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। অথচ এবারে প্রাধিকার কোটার চাকরি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই ভাগ বসানো হলো। আর তা করতে গিয়েই আজকের হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এত বিশালসংখ্যক প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার আয়োজন, মূল্যায়নের ব্যবস্থাসহ এটি একটি মহাযজ্ঞের রূপ নিয়েছে। আর তা করতে গিয়ে সঠিক মেধা যাচাই করা যাবে কি না, এ সংশয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। উঁচু মানের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে অধিক মেধাবীদেরই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা উচিত, অন্যদের প্রিলিমিনারি পর্যায়েই বিদায় নেওয়ার কথা।
ভারতে কেন্দ্রীয় ও সর্বভারতীয় চাকরির সংখ্যা সাধারণত প্রতিবছর হাজারের নিচেই থাকে। কয়েক লাখ প্রতিযোগী অংশ নেন প্রিলিমিনারি পর্বে। লিখিত পরীক্ষার জন্য মেধা অনুসারে নেওয়া হয় শূন্য পদের ১১ থেকে ১২ গুণ প্রার্থী। আর লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শূন্য পদের শুধু দ্বিগুণ প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। এতে প্রতিযোগীদের প্রতি পরীক্ষকেরা অধিকতর সুবিচার করার সুযোগ পান। ইচ্ছা-অনিচ্ছার আশঙ্কা হ্রাস পায়। আর আমরা ধরে-বেঁধে কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছেই সমর্পণ করি হাজার হাজার প্রতিযোগীকে। প্রাধিকার কোটা সম্পর্কে অনেক লেখালিখি হয়েছে। মোট পদের ৫৫ শতাংশ নিয়ে নিচ্ছে সে কোটা। উপজাতি, মহিলা আর কতিপয় পশ্চাৎপদ জেলার জন্য কিছু জেলা কোটা ছাড়া অন্য কোনো ধরনের কোটা সংরক্ষণের সাংবিধানিক কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এ দেশের স্থপতিরা সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশের সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সংবিধানের মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সব নাগরিকের সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সে অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদে সমাজের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, তার বিশেষ বিধান করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তাহলে অন্য কোটাগুলোর আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি কী, তা বোধগম্য নয়।
তদুপরি, সেসব কোটা যে অনুপাতে রাখা আছে, তা প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে বারংবার এটা দৃশ্যমান হচ্ছে। কোনো কোনো কোটায় উপযুক্ত প্রার্থীই পাওয়া যায় না। আর সেখানে প্রার্থী খুঁজতে উপযুক্ততা হ্রাস আমরা আর কতটা করব, তাও ভেবে দেখা দরকার। ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে ঢালাও পাস এ ধরনের একটি অযাচিত প্রক্রিয়া বলে কেউ কেউ মনে করেন। মেধা ও যোগ্যতাকে অবজ্ঞা করে আমরা বেসামরিক প্রশাসনের মান ক্রমে নিম্নমুখী করে চলছি। কোটা আগেও ছিল, এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও কিছু না কিছু থাকবে। তবে সেটা কি অনুপাতে হবে আর কাদের জন্য থাকবে, তা সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের দাবি রাখে। আর সে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে এবং প্রস্তাবনার চেতনায়। সংবিধানের প্রস্তাবনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আছে। আমরা আজ দেশে প্রতিনিয়ত স্বাধীনতার চেতনা আর সংবিধান সমুন্নত রাখার কথা শুনতে পাই। যাঁরা এগুলো বলেন, তাঁদের উচিত সরকারি চাকরিতে প্রবেশাধিকারে মেধাবীদের আড়াল করে রাখার প্রচেষ্টার অবসান ঘটানো। প্রাধিকার কোটা যাদের জন্য থাকার কথা, তা-ই থাকবে। আর তাও থাকবে বাস্তব চাহিদার অনুপাতে। এর অন্যথা করে দেশের বেসামরিক শাসনযন্ত্রটিকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে দিলে চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই দুর্বল হবে। গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ও দৃঢ় ভিত্তির জন্যও মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটা কিন্তু আমাদের ছিল। কিন্তু হেলায় তা আমরা ভেঙে ফেলছি। ৩৪তম বিসিএস নিয়ে এযাবৎ যা ঘটল, তা হয়তো বা একসময় নিষ্পত্তি হবে। অন্যদিকে ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে হাজার দেড়েক কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও শিগগিরই জারি হবে বলে জনপ্রশাসনবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এ ধারাবাহিকতার আবশ্যকতা রয়েছে। কারও কারও আশঙ্কা,
সে ৩৫তম বিসিএসেও প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অর্ধলক্ষাধিক বা তার বেশি পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়া হতে পারে আগেরটির ধারাবাহিকতায়। এমনকি কোটাপদ্ধতি প্রিলিমিনারি থেকেই চালু করার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এ আশঙ্কাগুলো যথার্থ না হোক, তা সবাই চান। তবে সংগত কারণেই অনেকেই শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকার জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাদের অতি ক্ষুদ্র দু-একটি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই নেই। সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটাতে একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করা হচ্ছে। সুশাসনের জন্য যেসব উন্নয়ন-সহযোগী কাজ করছে, তারাও এ ধরনের একটি আইনের জন্য বারবার দাবি রাখছে। এ ধরনের দাবির মুখে কখনো সিভিল সার্ভিস আইন আর কখনো বা পাবলিক সার্ভিস আইন নামে খসড়া তৈরি হয়েছে। আবার খসড়াগুলো তাদের স্বাভাবিক অবস্থান হিমাগারেই আছে। আর এগুলোতে নতুন বিতর্কও সামনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা রয়েছে। উভয় খসড়ায় শীর্ষ পদগুলোতে ক্যাডারের বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। এমনিতেই এ ধরনের কিছু সুযোগ সীমিত আকারে রয়েছে। তবে আইন করে ঢালাওভাবে তা দেওয়া হলে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারের আশঙ্কা ক্রমবর্ধমান হবে। এমনিতেই ক্যাডার পদে যোগদানে মেধাবীদের একটি অংশের অনীহা রয়েছে। এর কারণ অনেক। এর মধ্যে অপ্রতুল বেতন-ভাতা, ক্রমহ্রাসমান মর্যাদার কথা উল্লেখ করা যায়। তার পরও যাঁরা চান, তাঁদের অনেকেই আটকা পড়েন কোটার বেড়াজালে। তদুপরি, শীর্ষ পদগুলোতে বাইরে থেকে চুক্তিতে নিয়োগের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করলে এ পথে মেধাবীদের আসতে আগ্রহই বা থাকবে কেন? মনে হচ্ছে আমরা জেনে-শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের সম্ভাবনাময় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি জনপ্রশাসনকে বিপন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.