চরাচর-শীতের আরাম মালসায় by আহমেদ রিয়াজ

আমাদের দেশে ঘরে ফায়ারপ্লেস স্থাপনের মতো শীত পড়ে না। শীতও পড়ে মাত্র দুই থেকে তিন মাস। শীতের তীব্রতা আর আগের মতো নেই; মাঝেমধ্যে পড়ে কেবল। এক সময় শীত পড়ত গ্রামে। কিন্তু তরুণ আর যুবকদের অতটা কাবু করতে পারত না। কাবু হতেন বয়স্করা।
শীতের রাতে আগুনের উত্তাপ পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো বহনযোগ্য এক ধরনের ফায়ারপ্লেস। এর নাম অঙ্গারদানি। আগুনের মালসাও বলা যায়। মালসায় জ্বলন্ত তুষ বা কয়লা ভরে সেটা রাখা হয় হাতের কাছে। রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায়। এর আরেক নাম ধুনুচি। তবে এমন জ্বলন্ত পোড়ামাটির ভাণ্ডের ব্যবহার যেহেতু গ্রামেই বেশি, সে কারণে এমন শুদ্ধ শহুরে নামে একে চেনা খুব কষ্টকর। এর বহুলপ্রচলিত নাম 'আইল্লা'। কোথাও বলে 'হাইল্লা'। আইল্লা বা হাইল্লা- যা-ই হোক, এমন মোবাইল ফায়ারপ্লেসের রয়েছে বিরাট সুবিধা। যেখানে খুশি সেখানে বয়ে বেড়ানো যায়। রাতে ঘুমানোর সময় সাবধানে কাঁথার ভেতরেও ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। তবে বেহুঁশ বুড়ো মানুষের কাছে ব্যাপারটা নিরাপদ নয়। রাতে ঘুমের ঘোরে অনেক সময় ধাক্কা খেয়ে আইল্লা উল্টে যায়, পুড়ে যায় কাঁথা। এ থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভারতের কাশ্মীরে কিন্তু এর ব্যবহার ব্যাপক। কাশ্মীরে এর নাম কাঙ্গির। এর দুটি অংশ। বাইরের অংশ একটা খাঁচা; বেত, বাঁশ বা চটের তৈরি। এর ভেতরে থাকে মূল অংশটা, আমাদের দেশের আইল্লার মতো মাটির তৈরি পাত্র। গোলাকার পাত্রটির আলাদা নামও আছে- কণ্ডুল। এই কণ্ডুল ভরা হয় কাঠকয়লা আর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে। মাঝারি আকারের একেকটি কণ্ডুলে আধা কেজি কয়লা ধরে। আর কয়লা থেকে উত্তাপ পাওয়া যায় কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা। অনেক সময় কয়লার বদলে ভুসি আর শুকনো গোবর ব্যবহার করে কিছু কাশ্মীরি। আমাদের দেশের আইল্লায়ও কাঠকয়লার সঙ্গে তুষ বা ভুসির ব্যবহার রয়েছে। পুরো শীত মৌসুমে কাশ্মীরে কাঙ্গিরের ব্যবহার চোখে পড়বেই। এদিকে আমাদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আইল্লা। শীতের তীব্রতা কমে যাওয়ার কারণ তো আছেই, গরম কাপড়ের অভাবও আর আগের মতো নেই। আগের মতো খড়ের ঘরও নেই। গ্রামে গ্রামে ইটের দালান তৈরি হচ্ছে। ইটের দালানের ভেতর শীতের প্রবেশাধিকার খড়ের ঘরের চেয়ে কম।
কাঙ্গির বলুন আর আইল্লা বলুন, জিনিসটি কিন্তু প্রায় এক। এর প্রচলন যে কবে শুরু হয়, তার সঠিক হিসাব জানা নেই। ১৮৮৫ সালে জে এইচ নোয়েলসের অভিধানে পাওয়া গেছে আইল্লার খবর। তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি লিখেছেন, কাশ্মীরিরা কাঙ্গিরের ব্যবহার শিখেছে ইতালীয়দের কাছ থেকে। মোগলদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যখন ওই উপত্যকায় যেতেন, তখন তাঁদের সঙ্গে বিদেশিও থাকত। তবে তাঁর এ কথা যে নির্ভেজাল, সেটাও হলফ করে বলতে পারেননি নোয়েলস; শুধুই তাঁর অনুমান। বরং উল্টোটাও বলা যায়- কাশ্মীরিদের কাছ থেকেই ইতালীয়রা এমন মোবাইল ফায়ারপ্লেসের হদিস পেয়েছে। কারণ কাশ্মীরের অনেক উপকথা আর লোককথায় কাঙ্গিরের কথা আছে। এমনও হতে পারে, কাশ্মীর থেকে বেত-চটের কাপড় খুলে ন্যাংটো কাঙ্গির আমাদের এ অঞ্চলে এসে আইল্লা হয়ে গেছে, কিংবা আমাদের আইল্লা কাশ্মীরে গিয়ে বেত-চটের কাপড় পরে কাঙ্গির হয়েছে। যেহেতু কোনোটিরই কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, সেহেতু কিছুই বলা যায় না; শুধু এটুকু বলা যায়- শীতের আরাম মালসায়।
আহমেদ রিয়াজ

No comments

Powered by Blogger.