‘বাংলাদেশ ইমম্যাচিওরড, যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচিওরড’ by খুররম জামান

যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচিওর গণতান্ত্রিক দেশ। আর বাংলাদেশ হল ইমম্যাচিওর গণতান্ত্রিক দেশ। তাই যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে নির্বাচন হয় সেভাবে বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এ অভিমত বুধবার সকালে হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশস্থ মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত ডামি ভোট অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থকদের।

অনুষ্ঠানস্থলে পৃথক পৃথকভাবে বাংলানিউজের কাছে তারা এ অভিমত প্রকাশ করেন।
বিপরীতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার বিরোধীরা।

পৃথক পৃথক বক্তব্যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়েও অভিমত প্রকাশ করেন তারা।

এদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ,  জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আতাউর রহমান ও সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রমুখ।

অপরদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ।

এছাড়া নির্বাচন কমিশন আরো শক্তিশালী করার কথা বলেন সাবেক তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমির। আর সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, “মার্কিন এ নির্বাচন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন।”

“তাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশে এটির দাবি কেন করছেন?” এ প্রশ্নের উত্তরে মওদুদ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচিওরড গণতান্ত্রিক দেশ। আর বাংলাদেশ হল ইমম্যাচিওরড গণতান্ত্রিক দেশ। আমেরিকায় যেভাবে নির্বাচন হয় সেভাবে আমাদের এখানে সম্ভব নয়। এমনকি ভারতে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশে তা-ও সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশের রুলিং পার্টি  বিরোধীদলের ওপর যে নিষ্পেষন চালায় যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে তা হয় না।”

তিনি প্রশ্ন করেন, “ওবামা কি রমনির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেছেন? বিরোধীদলের নেতাদের কি অ্যারেস্ট করেছেন?  প্রশাসনকে করায়ত্ত করার জন্য সচিব থেকে কেরানি পর্যন্ত কি নিয়োগ দিয়েছেন?”

মওদুদ আরো বলেন, “১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাব না। তাই আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা মেলানো ঠিক হবে না। বাংলাদেশ তো আমেরিকা নয়।”

চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ বলেন, “গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সাংবিধানিক করতে হলে একটি নির্বাচন সম্পূর্ণ করাই হলো সবচেয়ে বড় কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আমরা লক্ষ্য করেছি- সে নির্বাচন নিয়ে বির্তক রয়েছে। তাই যদি একটি রাজনৈতিক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় এবং তা জনগণ গ্রহণ করে তাহলে এর বিকল্প কিছুই হতে পারে না।”

প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, “বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই গভীর। এ নির্বাচনের ফলাফলে দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না।”

ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কিন্ত সেখানে ফেডারেল সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে একটি ভারসাম্য রয়েছে। নির্বাচন সঠিকভাবে সম্পন্ন করা প্রতিটি রাজ্যের দায়িত্ব। এখানে কেন্দ্র কোনো সময় প্রভাব বিস্তার করে না। তার ওপর রয়েছে ইলেকশন অ্যাসিসট্যান্স কমিশন। তারা শুধুই নির্বাচন মনিটর করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনের ওপর আমরা নির্ভর করতে চাই। এটি ঠিক নয়।”

তিনি বলেন, “আমেরিকার নির্বাচন হল টোটাল প্রসেস। এখানে সরকার, জনগণ, সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়ার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আমেরিকার এ নির্বাচন প্রক্রিয়া ২শ’ বছরের ঐতিহ্য। আমরা মনে করি, এ ঐতিহ্য এমনিই আসবে। কিন্তু এটি এমনিই আসবে না। আমাদের দেশে সামান্য ছুতায় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমেরিকার নির্বাচন স্থির ও নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। স্যান্ডির আঘাতের পরেও জরুরি অবস্থার মধ্যে সেদেশে ৯ রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।”

আতাউর রহমান বলেন, “আমেরিকার দুই পার্টির মধ্যে আস্থা আছে, বাংলাদেশে নেই। সে দেশ আর যাই হোক, নির্বাচন বানচালের মত কিছু করবে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাবের জন্য তৃতীয় শক্তি সুযোগ নেয়।”

সাবেক তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমির বলেন, “এ নির্বাচনের মধ্য থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। একটি স্থায়ী সরকারে অধীনে যে নির্বাচন করা অবশ্যই সম্ভব তা এ নির্বাচন দেখে বোঝা যায়।”

তিনি বলেন, “জনগণকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে এবং সাধারণভাবে মৌলিক আইন বদলাতে গেলে আইন টিকে থাকে না। তাই আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করা উচিৎ। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা দরকার।”

বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনের তফাতটা হল মার্কিন নির্বাচনে সেনাবাহিনী বা পুলিশের কোনো ভূমিকা উচ্চারিত হয় না। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই কিভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এতোবড় দেশে একটি নির্বাচন হতে পারে। এখান থেকে আমাদের শেখার আছে। আমেরিকা যে গোটা বিশ্বে রাজত্ব করছে, বলা হয়ে থাকে তারা সেটি করছে সেনাবাহিনী ও ডলারের শক্তির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এটি ভুললে চলবে না যে, তার রয়েছে গণতন্ত্রের জন্য একটি আদর্শিক শক্তি। এ নির্বাচন দেখে বিশ্বে অন্যন্য দেশও উজ্জীবিত হবে।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে চায় এবং অবৈধভাবে থাকতে চায়। এ জন্যই তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন এবং এ প্রয়োজন তারাই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। এখন তারা উল্টো পথে হাঁটছে। যে দলের নেত্রীর কথা রাতারাতি বদলে যেতে পারে, সে দলের অধীনে নির্বাচন কোনো দিন হতে পারে না।”

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “যুক্তরার্ষ্টের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনে রয়েছে রাত ও দিনের তফাত। বাংলাদেশের নির্বাচনে বিশ্বাস করা যায় না, কারচুপি হবে কি হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যারা হেরে যাবে তারা কেউ বলবে না যে, কারচুপি হয়েছে। শত বছর ধরে তারা গণতন্ত্র দাঁড় করতে পেরেছে, আমরা পারি নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক অপরিহার্য। কারণ, নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী নয়। আমাদের দেশে ব্যালট ছিনতাই হয়, অর্থ দিয়ে ভোট কেনাবেচা হয়। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন করলে আমরা খুশি হতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এটি সম্ভব নয়।”

No comments

Powered by Blogger.