'আওয়ার ইন্টারেস্ট' by মহসীন হাবিব

মহামান্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, গত সপ্তাহে আপনার কাছে চিঠি আকারে একটি নিবন্ধ লিখে পাঠকদের সাড়া পেয়েছি। তাই আরো একটি নিবন্ধ লেখার লোভ সামলানো গেল না। তা ছাড়া কিছু কথা মনের মধ্যে খুটখুট করে কামড়াচ্ছে। সেগুলো না লিখতে পারলে কামড়াতেই থাকবে।


আপনাদের শকুনের দৃষ্টির তুলনায় আমাদের দৃষ্টি মোটা কাচের, ভাঙা চশমা চোখে দাদিমার সমান। আপনারা যা আজ দেখতে পান, আমরা তা দেখি কুড়ি বছর পর। অথচ এই কুড়ি বছরে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ভূগোল_সবকিছু পাল্টে যায়। ১৯৫৭ সালে ডুয়াইট ডি আইসেনহাওয়ার প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে আপনাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন হোরেস এ হিল্ডরেথ। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে দুই পাকিস্তান একসঙ্গে থাকার নয়। গুলাম মোহাম্মদ অসুস্থ হয়ে পড়লে পাকিস্তানের ক্ষমতার মঞ্চে উঠে আসেন ইস্কান্দার মির্জা। ইস্কান্দার মির্জাকে সমর্থন দেওয়া না দেওয়ার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ কতটা নিহিত আছে তা নিয়ে যখন তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিকরা মহাচিন্তিত, তখন হোরেস এ হিল্ডরেথ রিপোর্ট করে জানিয়েছিলেন, East Pakistan would interpret such an approval as Washington's support for the Punjabi tyranny and victimization of their province.
তিনি রিপোর্ট করেছিলেন, আওয়ামী লীগ একটি সেক্যুলার, মধ্যবিত্ত মানুষের দল। তারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, While we have regarded our interests as better served by a unified Pakistan, we should be able to adjust to the emergence of the two separate states and to maintain satisfactory relations with them without serious damage to our interest.
দেখুন, আপনাদের যুক্তরাষ্ট্র যখন এমনভাবে বিশ্লেষণ করছে, তখন আমাদের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক ঝানু রাজনীতিবিদ বা কূটনীতিবিদও পাকিস্তানের কাছ থেকে দাবি-দাওয়া আদায়ে সোচ্চার, কিন্তু এই সেপারেট স্টেটের কথা মাথায় রাখেননি। 'আওয়ার ইন্টারেস্ট', 'আওয়ার ইন্টারেস্ট' করে যুক্তরাষ্ট্র তখন ইস্কান্দার মির্জাকে সমর্থন দিয়েছিল; এবং তখনই সেই আমলে ইস্কান্দার মির্জাকে আপনাদের রাষ্ট্রদূত হোরেসকে সব বিষয়ে অবগত করতে হতো!
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই বছর আগের কথা। আইয়ুব খানের বিরোধী দলের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার সময় ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক থমাস এল হিউজেস তাঁর প্রেরিত এক রিপোর্টে মন্তব্য করেছিলেন, The country will be fortunate if it emerges from this period of stress as a single nation.
আপনাদের এ দূরদর্শিতার প্রশংসা না করে পারি? ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল ১১ মার্চ একটি গোপন বৈঠকের মাধ্যমে। পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তরে সে গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল হামিদ খান, এস জি এম এম পীরজাদা, গুল হাসান খান, টিক্কা খান, গুলাম উমর এবং আকবর খান। এই হামলা চালানোর কথা ছিল ১৭ মার্চ। পরে তারিখ পরিবর্তন করা হয়। এ হামলা পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের ডেপুটি চিপ এস এ সৌদ। এস এ সৌদ বাঙালি সেনা অফিসারদের কাছে এ গোপন বৈঠকের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। করাচিতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলার জেনারেল ১১ মার্চ স্টেট ডিপার্টমেন্টকে এ গোপন বৈঠকের কথা জানান। পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর লে. জে. ইয়াকুব খান হামলায় রাজি না হওয়ায় তাঁকে ইসলামাবাদে বদলি করা হয়। তিনি যখন সপরিবারে করাচি থেকে ইসলামাবাদ রওয়ানা হন, তখন পাকিস্তানের ফিলিপ ইলেকট্রিক কম্পানি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার ডার্ক ইয়োঙ্গানিল স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানান, Yakub Khan passed through Karachi with his wife on his way to Islamabad.
এই হলো আপনাদের প্রসারিত হাতের নমুনা। এত কিছুর পরও, এত কিছু অবগত হয়েও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের ছাড়তে পারেনি। মাননীয় প্রেসিডেন্ট, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন সামরিক একনায়ক হলেন পাকা আমের ভেতরে পোকার মতো। উপমহাদেশে, বিশেষ করে পাকিস্তান, বাংলাদেশে; আফ্রিকার তেল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে যত অভিশপ্ত ব্যক্তি জাতির ভাগ্যকে বজ্রমুষ্টি দিয়ে চেপে ধরেছে, তাদের প্রত্যেকেই আপনার দেশের সৃষ্টি। প্রয়োজনমাফিক আপনারা এক শয়তান সরিয়ে অন্য শয়তানকে গদিনসীন করছেন। কোন মতাদর্শের লোক ক্ষমতায় আসছে, সেটা আপনাদের যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিতে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, আপনাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা পেল সেটাই মুখ্য। তাই আরেকবার শঙ্কা জেঁকে বসেছে। আপনাদের প্রেডিকশন বা ভবিষ্যদ্বাণী আমরা ফেলতে পারি না। মাত্র তিন বছর আগে কংগ্রেস কমিটির জন্য তৈরি একটি রিপোর্টে বলা হয়, 'Some analysts are concerned that Islamist parties have gained influence through the political process and that this has created space for militant activities inside the country. Some allege that the presence in the former ruling Bangladesh National Party (BNP) coalition government of two Islamist parties, the Islami Okizya Jote (IOJ) and the Jamaat-e-Islami, contributed to the expansion of Islamist influence in Bangladesh.' (উইকিলিকস)
এমনটাই কি আমরা দেখতে পাচ্ছি ফজলুল হক আমিনীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে? বাংলাদেশে যদি তীব্র কোনো আন্দোলন তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা কী হবে? গণতন্ত্র রক্ষা করবেন, নাকি 'আওয়ার ইন্টারেস্ট' বলে অন্য কোনো বিকল্প পথকে শক্তি জোগাবেন? ২০০১ সালের নির্বাচনে বিদেশি (মূলত পশ্চিমা মুখপাত্র) পর্যবেক্ষকরা এসে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলেন। উচ্চৈঃস্বরে তাঁরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত হয়েছে। সেই নির্বাচনে কমপক্ষে ১০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে ধর্ষণ, নির্যাতন চলেছে তা আজ কাচের মতো পরিষ্কার। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যম ফলাও করে ছাপিয়েছে, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর প্রশংসার সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছিল, বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি উৎখাতের শপথ গ্রহণ করেছেন! এশিয়াউইক লিখল, জিয়াস ভিক্টরি! মোহন সিরিজের সেই গোয়েন্দা কাহিনীর মতো, তারপর কী দিয়ে কী যেন হয়ে গেল!
এখন কিসে, কতটা ভরসা রাখব বুঝে উঠতে পারছি না। সম্প্রতি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের পক্ষ থেকে আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অ্যানুয়াল হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। ১৯৪টি দেশের ওপর তৈরি ২০ লাখ শব্দের এবং সাত হাজার পৃষ্ঠার এ রিপোর্টটিতে বাংলাদেশ অধ্যায়ও আছে। আমি সে অংশ পড়েছি। বাংলাদেশ নিয়ে ১৭ হাজার শব্দের এবং প্রায় ৩৯ পৃষ্ঠাব্যাপী এ রিপোর্টে অনেক কথাই সঠিকভাবে বলা হয়েছে। তবে যে কেউ রিপোর্টটি পড়লে লক্ষ করবেন, প্রতিটি বাক্যে কোথায় যেন একটি ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। রিপোর্টের কিছু অংশে অতিরঞ্জনও আছে। এ রিপোর্টের সঙ্গে আপনাদের 'আওয়ার ইন্টারেস্ট' যে যুক্ত আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যে কতটা আক্রমণাত্মক হতে পারেন, তা তো আপনার চেয়ে বেশি কেউ জানে বলে মনে হয় না। মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়নের সময়ে এই হিলারি আপনার বাপ, দাদা, চৌদ্দ গোষ্ঠীকে ধুয়ে দিয়েছিলেন। যা হোক তার পরও আপনাদের গণতন্ত্র এতটাই নিয়ম মেনে চলে যে হিলারিকেই আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়েছে। এটি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি ভিন্ন আলোচনা।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, বড় ভয় পাই আপনাদের 'আওয়ার ইন্টারেস্ট' বাক্যটিকে। এই বাক্য আপনাদের অন্য সব বাক্য ও প্রতিশ্রুতিকে মুহূর্তের মধ্যে উধাও করে দেয়। আপনি কয়েক দিন আগে বলেছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশ থেকে আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনবে। সে হিসাবে আগামী ১৫ বছর পর কি তেল-পানি কোথাও কিছু থাকবে?
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ভয় পাই আপনাদের কায়িক শক্তিকে। পাকিস্তানের মতো একটি মাথা গরম এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী দেশ গত সপ্তাহে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছে, আপনারা যেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভূমিতে আর বিমান হামলা (ড্রন) না চালান!
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.