বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৬৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শামসুল আলম, বীর উত্তম সফল এক বিমানযোদ্ধা শামসুল আলম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) রাওয়ালপিন্ডিতে। চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমান-বাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এতে যোগ দেওয়ার সুযোগ


খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোনোভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে সুযোগ হলো জুন মাসে। তখন ছুটি নিয়ে কয়েক দিন করাচিতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে কৌশলে ঢাকায় আসেন। এতেও শেষরক্ষা হলো না। ঢাকায় আসামাত্র তাঁকে আটক করা হয়।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে আটক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। শামসুল আলম এর আওতায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। এর কয়েক দিন পর তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
তখন ভারতে সবে শুরু হয়েছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠনের প্রক্রিয়া। সেখানে যাওয়ার পর শামসুল আলমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিমান উইংয়ে। কয়েক দিন পর শুরু হয় তাঁদের প্রশিক্ষণ। নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণে অটারের মতো বেসামরিক বিমানের সাহায্যে সঠিক নিশানায় বোমা, রকেট ইত্যাদি নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
শামসুল আলম অপারেশন করেন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ভারতের কমলপুর থেকে তিনি ও আকরাম আহমেদ অটার বিমান নিয়ে যাত্রা শুরু করেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। এই বিমানে কাঁটা-কম্পাস ছাড়া দিক নির্ণয়ের আর কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ছিল না। এ জন্য তাঁদের বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম অপারেশনে যাওয়ার সময় তাঁরা যেন তেলিয়ামুড়ার ওপর দিয়ে উড়ে যান এবং সেখানে উপস্থিত হলে বিমানের দৃশ্যমান বাতিগুলো যেন তাঁরা কয়েকবার জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দেন। তখন প্রত্যুত্তরে নিচ থেকে মশালবাতি জ্বালানো হবে। এতে বোঝা যাবে, বিমানটি যথাসময়ে ও সঠিক সময়ে অগ্রসর হচ্ছে। পথচ্যুতি ঘটলে তাঁরা সঠিক পথ নির্ধারণ করে নিতে পারবেন।
শামসুল আলম ও আকরাম আহমেদ চট্টগ্রামের উপকূল রেখা-বরাবর উড়ে যথাসময়ে পৌঁছান ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের আধারগুলোর কাছে। আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল মধ্যরাত। ঠিক রাত ১২টা এক মিনিটে গর্জে ওঠে তাঁদের বিমানে থাকা রকেটগুলো। প্রথম দুটি রকেট তেলের ডিপোতে নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানে। মোট চারবার তাঁরা সেখানে আক্রমণ চালান। সফল এই আক্রমণে ইস্টার্ন রিফাইনারির চারদিকের তেলের ডিপোগুলো দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে থাকে।
সিদ্ধান্ত ছিল, শামসুল আলমেরা চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে একবারই আক্রমণ করবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, প্রথম আক্রমণে মূল লক্ষ্যস্থলে রকেট নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানলেও কয়েকটা তেলের আধার অক্ষত। বিমানে তাঁদের কাছে মজুদ আছে বেশ কয়েকটি রকেট। তখন তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধা সিদ্ধান্ত নেন পুনরায় আক্রমণের। পরের আক্রমণ ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ততক্ষণে নিচ থেকে শুরু হয়েছে পাকিস্তানিদের গুলিবর্ষণ।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শামসুল আলমকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৬১।
শামসুল আলমের পৈতৃক বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার পাতিলাপাড়া গ্রামে। তবে তিনি ঢাকায় (ট্রেলিস গার্ডেন, ৩৩ সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ, বারিধারা) বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার। মা শামসুন নাহার বেগম। স্ত্রী শামীম আলম। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: শামসুল আলম বীর উত্তম ও একাত্তরের যুদ্ধে বিমানবাহিনী, শ জামান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.