আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৩)-আপনজনের ঋণ অপরিশোধ্য by আলী যাকের

আমি নিশ্চিত যে কারো জীবনই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। জীবনের চলার পথে কোনো না কোনো সময় নানা রকম ধাক্কা আসে। মানুষ সামলে উঠে আবার পথচলা শুরু করে। দিদি চলে যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের পরপর এই তিনটি মৃত্যু আমায় বিচলিত করেছিল। কেবল বিচলিত নয়, আমার নিজের মানসিক ভারসাম্যই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম_এ কথা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই আমার। তবে এই ঘটনাগুলো এক অভাবনীয় শক্তির সঞ্চারও করেছিল আমার মধ্যে।


কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি আমি, ছাদের ওপর বসে, আকাশে দৃষ্টি দিয়ে_তার হিসাবও নেই আমার কাছে। হঠাৎ এক অমাবস্যার রাতে, আকাশ যখন তারায় ঝলমল, তখন ওপরের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, 'আরে! ওই তো আছে সবাই, জ্বলজ্বলে তারা হয়ে আমার মাথার ওপরে।' এখনো যখন আমি আমার ওইসব আপনজনকে খুঁজি, রাতের আকাশে তাকালে তাদের দেখতে পাই। জীবন যতই এগোচ্ছে, অস্তাচলের দিকে, তারার সংখ্যাও বাড়ছে বৈকি। কিন্তু আমার আপনজন আমার দৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে নিরন্তর। আমার চেয়ে বয়সে কম অনেকেই তাদের আপনজনকে হারিয়েছে। আমি তাদেরও বলি আকাশের তারার মাঝে খুঁজে নিতে, যারা চলে গেছে তাদের। বাবা থেকে দিদি_এই তিনটি মৃত্যুর মধ্যে আমি অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। অনেক কিছু হারিয়েছি, আবার অনেক কিছু পেয়েছি। অনেক বন্ধু পেয়েছি, অনেক দর্শন সম্পর্কে জেনেছি, অনেক স্বীকৃতিও পেয়েছি ভালো কাজের জন্য। এগুলো কোনো কিছুই একটি জীবনের জন্য তুচ্ছ নয়। দিদির চলে যাওয়ার পর বড় স্নেহের আশ্রয় পেয়েছি আমি আমার অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের কাছে। আমার খালাতো বোন নিলুফার খায়ের দিদির অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন প্রতিনিয়ত। ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর পরিপূর্ণ সংসার। তবুও তিনি প্রায় প্রতিদিন আমাদের গেণ্ডারিয়ার বাসায় আসতেন খবর নেওয়ার জন্য। ভালো-মন্দ খাবার সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। আপনজনের কাছেও মানুষ ঋণী হতে পারে_আমি তা আমার আপনজনের কাছেই শিখেছি। এ ঋণ অপরিশোধ্য।
আমি ঠিক করলাম, সব শোক সামলে উঠে আমি আমার অনার্স পরীক্ষা দেব। প্রস্তুতি শুরু হোক এখনই। আমার পড়াশোনার ক্ষেত্রে একটা অনিয়ম হয়েছিল। আমি কোথাও উল্লেখ করেছি বোধ হয়, মায়ের মৃত্যুর জন্য আমার সাবসিডিয়ারি এবং ফাংশনাল ইংলিশ পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। অতএব, অনার্সের আট পেপার, একটি রিসার্চ মনোগ্রাফ, সাবসিডিয়ারির চার পেপার এবং ১০০ নম্বরের ফাংশনাল ইংলিশ একসঙ্গে দেব বলে নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করলাম। গেণ্ডারিয়ার বাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর। যাওয়া-আসায় অনেক সময় নষ্ট হয়। তাই ঠিক করলাম, হলে চলে যাব। আমি তৎকালীন ইকবাল হল, বর্তমানের জহুরুল হক হলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম, কিন্তু আমার নামে কোনো রুম বরাদ্দ ছিল না। তাই আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে তার রুমে জায়গা করে নিলাম। আমার এই বন্ধু, আবদুল মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং আমেরিকান সেন্টার থেকে অনেক পরিশ্রম করে যেসব নোট নিয়ে আসত, তার সবই আমাকে পড়তে দিত। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, পরীক্ষার আগে তিন মাস আমি দিনের আলো দেখিনি। রাতে হলে খাওয়ার পর একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বাইরে যেতাম। বড়জোর ১০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করতাম।
তারপর আবার পড়ার টেবিলে। আমার তখন একটিই লক্ষ্য যে আমাকে আমার লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমার এই উপলব্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার মা-বাবা ও দিদি। তাঁরা যখন কাছে ছিলেন, তখন তাঁদের সম্পর্কে খুব একটা ভাবিনি। তাঁরা যখন দূরে চলে গেলেন, আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে, তখন অনেক সত্য হয়ে এল তাঁদের উপস্থিতি আমার জীবনে। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। এমন এক প্রভাব, এমন এক দুর্মর এবং অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি তাঁদের আমার জীবনে যে সেই তখন থেকে নিয়ে আজ এই জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত যেকোনো সিদ্ধান্তে তা দেখা দেয় অনিবার্যভাবে।
পরীক্ষার যখন কেবল আর সপ্তাহ দু-এক বাকি, আমি আমাদের গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে গেলাম কোনো একটি কাজে। গিয়ে দেখি, সেখানে একটি পোস্টকার্ড আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই পোস্টকার্ডটি এসেছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে। বক্তব্য সহজ, আমি অনার্স পরীক্ষা দিতে পারব না। কেননা অনার্স পরীক্ষা দিতে হলে অন্ততপক্ষে একটি সাবসিডিয়ারি বিষয়ে পাস করা আবশ্যিক ছিল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ছুটে গেলাম ইকবাল হলের প্রভোস্টের দপ্তরে। আমার জিজ্ঞাস্য, এটাই যদি নিয়ম হবে তাহলে তিনি কেন আমার পরীক্ষার আবেদনপত্রে সই করেছিলেন? তখন ইকবাল হলের প্রভোস্ট ছিলেন প্রয়াত বোস অধ্যাপক ড. মতিন চৌধুরী। আমি তাঁকে সবিস্তারে বললাম আমার সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা না দেওয়ার কারণ। তিনি বললেন, 'তোমার মায়ের মৃত্যুর পর মানসিক অবস্থা যা ছিল তাতে তোমার পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়, এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তো একটা নিয়ম আছে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম আমি করি কী করে?' আমার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। ভাবলাম, এত কষ্টের পরে এত দুঃখের সাগর পেরিয়ে তীরে এসে যদি তরী ডুবে যায় তাহলে আমি কোথায় যাব? এই মুহূর্তে শেকসপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকের একটি সংলাপ আমার মনে পড়ছে_'এত দূর রক্তের নদীতে নেমে যদি ছেড়ে দিই সাঁতার তবে তীরে ফেরাও তো বড় কষ্টকর।' কী করব ভাবছি। ড. চৌধুরী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'একবার যখন আমি সই করে দিয়েছি, তখন যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। তুমি কাল সকালে উপাচার্যের ভবনে সকাল আটটায় উপস্থিত থাকবে।' কৃতজ্ঞতাবোধে আমার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এল।
(চলবে)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.