চরাচর-কবিগানের অপমৃত্যু by আলম শাহীন

বিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। দুই দলের তুমুল প্রতিযোগিতায় ও টানটান উত্তেজনার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই গান । অবশেষে একদল ছিনিয়ে নেন জয়ের মালা। এই মালার আবার দাবিদার থাকেন দলের প্রধান। তিনিই মূলত কবিয়াল। তাঁর নেতৃত্বে দল পরিচালিত হয়। হার-জিতের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী থাকেন তিনি। কারণ গানে গানে তিনিই প্রশ্ন করেন, আবার কঠিন প্রশ্নের জবাবও দিতে হয় তাঁকে। সহযোগীরা শুধু গানের 'ধুয়া' অংশটুকু গেয়ে থাকেন।


কবিয়ালের সঙ্গে তাঁরা কোরাস গান করেন। এঁদের বলা হয় 'দোহার'। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে কবিগানের প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল অনেকটাই সাজানো। কবিগানের ভাষায় তাকে বলা হতো 'বাধুটি'। সে সময় দুই দলের প্রধান আগেই ঠিক করে নিতেন তাঁদের প্রশ্নোত্তর পর্ব কী ধরনের হবে। অনেকটাই হালের জনপ্রিয় রেসলিং খেলার মতো সাজানো ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাম বসু নামক একজন বিখ্যাত কবিয়াল এ ধারাটি পরিবর্তন করেন, না জেনে গানের মধ্যে প্রশ্নোত্তর-রীতি প্রবর্তন করেন। উপস্থিত গান বাঁধার ফলে তখন থেকেই কবিগান তার প্রকৃত মাধুর্য লাভ করে এবং গ্রামগঞ্জে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিগানের প্রধান অঙ্গ চারটি। প্রথমে থাকে 'বন্দনা', এরপর থাকে সখী-সংবাদ, বিরহ ও খেউড়। 'বন্দনা' বাদ দিলে বাকি অঙ্গগুলো চাপান ও উতোরে চলতে থাকে। 'চাপান' হচ্ছে, গানের মূল প্রশ্নের অবতারণা। আর এ কাজটি করে প্রথম দল। দ্বিতীয় দলের দলপতি এর উত্তর দেন। কবিয়ালদের ভাষায় তার নাম 'উতোর'। গান চলাকালে কবিয়াল নিজেই গান বাঁধেন, সঙ্গে সুরও। অবশ্য দলের দোহারও তাঁকে সাহায্য করেন। তখন দোহারই হন 'বাঁধনদার'। অর্থাৎ সহযোগী কবিয়াল। এই গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল পৌরাণিক কাহিনী। অনেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়েও কবিগান বাঁধেন। তবে সেই আমলে মানুষ পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে গান বাঁধলে বেশি খুশি হতেন। সত্তরের দশকের পরও কবিগানের জয়জয়কার ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদনের প্রধান খোরাক ছিল এই কবিগানের আসর। দিনভর কাজকর্ম সেরে মেহনতি মানুষ কবিগান শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। শুধু তা-ই নয়, কৃষক-শ্রমিকরা এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। 'অমুক কবিয়াল সেরা, অমুক কবিয়ালের গলার সুর বসে গেছে' ইত্যাদি। এসব জল্পনা-কল্পনার পর রাতের খাবার খেয়ে নাতি-পুতি নিয়ে কবিগানের আসরে হাজির হতেন। সে কী জমজমাট আসর। আজকের আকাশ সংস্কৃতির যুগে তা কল্পনাই করা যায় না। মানুষের মধ্যে সেই আমোদ-প্রমোদ এখন আর নেই। নেই কবিয়ালদের সুসংগঠিত দলও। মরতে মরতে কোনো রকম টিকে আছেন তাঁরা। বংশপরম্পরায়ও এ পেশায় এখন আর কেউ আসছেন না। অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন পেশা পরিবর্তন করতে। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে অবলীলায় তাঁরা বলে ফেলছেন, 'কবিগান করলে পেটে ভাত জোটে না।' এ যদি হয় কবিয়ালদের আহাজারি এবং হালচিত্র, তাহলে কি বাংলার লোকসংগীতের অপমৃত্যু ঘটবে না? অঙ্গহানি ঘটবে না বাংলা লোকসংগীতের? বিষয়টা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার কাঁধে তুলে নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকব আমরা।
আলম শাহীন

No comments

Powered by Blogger.