লাল-সবুজের পাশে-‘ইউ মোনামি আই মোনামি পাদো প্রবলেম’ by আনিসুল হক

দালোয়া সত্যি অনেক বিস্ময়ই দেখাচ্ছে। কালো তরুণটিকে বলি, ‘তোমার নাম কী?’‘রোনালদো।’ ‘তুমি বাংলাদেশে যাবে?’ ‘যাব।’ ‘কোথায় যাবে?’ ‘রাজশাহী।’ ‘কেন, রাজশাহী কেন?’ ‘আমের জন্য। আমি আম পছন্দ করি।’ ‘দ্রগবার বাড়ি কোথায়?’ ‘এয়ারপোর্টের পেছনে।’
এই কথোপকথনের পুরোটাই হচ্ছে বাংলায়। কথা হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী মেডিকেল ইউনিটের হাসপাতালের সামনে। এখানে রোজ ভিড় করে স্থানীয় কৃষ্ণ নারী-পুরুষ-শিশু। তাদের সেবা দেওয়া এই বাঙালি চিকিৎসাসেবীদের চুক্তিবদ্ধ দায়িত্ব নয়। কিন্তু তাঁরা এই কাজ করেন। প্রতিদিন শত শত মানুষকে ব্যবস্থাপত্র দেন। ওষুধ দেন। শুধু তা-ই নয়, অস্ত্রোপচার করেন। অনেক লোকের শরীর থেকে বুলেট আর স্প্লিন্টার বের করেছেন এখানকার বাঙালি সার্জন লে. ক. মোখলেসুর রহমান। ২০ শয্যার হাসপাতালে ৫৬ জনের দক্ষ জনবল তাঁর। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়াই তাঁদের কাজ। কিন্তু তাঁরা স্থানীয় মানুষদের দুঃখকষ্ট দেখে স্থির থাকতে পারেন না। সেবা দিয়ে যান। বিনিময়ে পান এই গরিব অসহায় মানুষগুলোর শুভ কামনা। আউটডোরে বসে আছেন ৩৯ বছরের নারী ওনলিউ ওজিলি। তিনি এই যুদ্ধে তাঁর পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছেন।
এই হাসপাতাল দেখে গাড়িতে উঠছি, তখনই এই রোনালদোর সঙ্গে কথা হচ্ছে।
দালোয়া আইভরি কোস্টের একটা জেলা শহরের মতো। এক লাখ মানুষের বাস এই শহরে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর পশ্চিম সেক্টরের সদর দপ্তর এখানে। সেক্টর কমান্ডার বাংলাদেশি।
২৭ জানুয়ারি চিফ অব স্টাফ কর্নেল সাইফুল আবেদীন আমাদের সংক্ষেপে পশ্চিম সেক্টর সম্পর্কে খানিকটা বয়ান করলেন। আইভরি কোস্টের এই পশ্চিম সেক্টর আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও বড়। সেক্টর টুতে ৭৫০ জনের দুটি বাংলাদেশি ব্যাটালিয়ন ছাড়াও আছে নিজার ও মরক্কোর দুটি ব্যাটালিয়ন। এরা সবাই বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার মাহবুবুল হকের অধীনে।
দালোয়ায় আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ ব্যানইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসকদের দল ব্যানমেডিকেল, আছে বিমানবাহিনীর ব্যানএয়ার।
প্রকৌশলীদের দল ব্যানইঞ্জিনিয়ার। তাঁরা তাঁদের কাজের সচিত্র বর্ণনা দেখালেন ভিডিওতে। লে. ক. সাঈদ আহমেদ জানালেন, প্রকৌশলীদের এটা অষ্টম ব্যাচ। তাঁরা থাকার জায়গা বানান, মাটি খুঁড়ে রাস্তা বানান, হেলিপোর্ট বানাতে পারেন, বিমানবন্দর মেরামত করতে পারেন—প্রকৌশলীদের কাজ কি কম? কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা বোমা নিষ্ক্রিয় করেন। বোমা নিষ্ক্রিয় করার ছবি দেখে আমার রক্ত হিম হয়ে এল। আমেরিকা কোম্পানি বোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য লাখ লাখ ডলার দাবি করেছিল, বাঙালিরা সেখানে কোনো রকমের দুর্ঘটনা ছাড়াই এই যুদ্ধকবলিত দেশটিকে বোমামুক্ত করেছেন, উদ্ধার করা বোমা-বারুদ নিষ্ক্রিয় করেছেন। মানুষের বাড়ির টিনের ছাদে রকেট শেল পড়ে আছে, তাঁরা কোলে করে ধরে সেসব নামাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখা যায়? তাঁরা এ কাজ করে দিয়ে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন, প্রশংসিত হয়েছেন। শোয়েব নামের একজন কবিকে পাওয়া গেল, শাহরিয়ার শোয়েব নামে তিনি কবিতা লেখেন, তাঁদের কার্যক্রম নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা লিখে ভিডিওচিত্র বানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, একটা ক্রেন ভেঙে গেলে সেটা খুবই অল্প পয়সায় নিজের বুদ্ধিতে সারিয়ে দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের অনেক অনেক পরিমাণের ডলার সাশ্রয় করেছেন।
আমরা এবার যাব এয়ারপোর্টে, ব্যানএয়ারের কার্যক্রম দেখতে। কিন্তু যাব এপিসিতে। এপিসি (আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার) হলো একটা যুদ্ধ বা দাঙ্গায় ব্যবহারযোগ্য যান, দেখতে সাদা ট্যাংকের মতো, ভেতরে বসে থাকলে গুলি লাগবে না, কিন্তু ভেতরে আছে এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল...গুলি করা যায়। ইউএন লেখা নীল হেলমেট পরে আমরা উঠে পড়লাম লে. কর্নেল জিয়াউল হকসমেত। জিয়া আমাদের সঙ্গেই এসেছেন ঢাকা থেকে, তিনি ওভারসিজ অপারেশন দপ্তরে কাজ করেন, এর আগে আইভরি কোস্টে মিশন করে গেছেন, কাজেই তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যাপক, উৎসাহ অপার। আমাদের নীল রঙের ইউএন হেলমেট পরিয়ে এপিসিতে চড়িয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নেওয়া হলো। সঙ্গে আরও তিন বেসামরিক লোক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাহিদুল ইসলাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুবুল ইসলাম আর আইএসপিআরের নুর ইসলাম। জাহিদুল ইসলাম প্রচণ্ড রোদের মধ্যে একটা কালো কোট পরেন, কারণ এটা গরমকালে পরারই স্যুট। ‘এটার মধ্যে নিশ্চয়ই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বসানো আছে,’ আমি রসিকতা করি। আমরা সবাই এখানে বন্ধুর মতোই হয়ে গেছি। এপিসি চলছে, পেরিস্কোপে চোখ রেখে আমি দেখি দালোয়া শহরের রাস্তাঘাট।
ব্যানএয়ারের একটা হেলিকপ্টার নামল। আরেকটা উড়বে। দ্বিতীয়টা মহড়া দিচ্ছে। জরুরি রোগী কীভাবে তারা নিয়ে যায়, তারই মহড়া। শান্তির জন্য উড্ডয়ন—এ স্লোগান নিয়ে ১০৪ জন বিমানবাহিনীর সদস্য নিয়ে এই ব্যানএয়ার। তাঁদের আছে তিনটা বেল ২১২ হেলিকপ্টার। তাঁরা জানালেন, যখন পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল, অন্য দুটি দেশের বিমানসেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখনো তাঁরা তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ রাখেননি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম আমাদের তাঁর কার্যক্রমের একটা সচিত্র বিবরণ দেন। সংকটের সময় এঁরা ১৮ দিন খাবার পাননি, জাতিসংঘের পাঠানো শুকনো খাবার খেয়েছেন, তাও শেষ হয়ে এলে আফ্রিকানরা যে গাছের শেকড় খায়, কাসাবা নাম, সেটা পুড়িয়ে খেয়েছেন।
হেলিকপ্টারের ককপিটে বসি। মাথায় ওদের এয়ারফোন বাঁধি। পাশের পাইলটকে জিজ্ঞেস করি, কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো এত দিনে? ব্যানএয়ার এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি, তবে যদিও সংকটজনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, সেটা তাঁরা সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। বৈমানিক জলিল রংপুরের ছেলে। স্কয়াড্রন লিডার শহীদ আমার ভাগনেই হয়। এঁদের সঙ্গে দেখা হয়। এক ফাঁকে বলি, দেশের জন্য মন কাঁদে না? ওঁরা তখন দালোয়ায় কর্মরত চার নারী সেনাকর্তাকে দেখিয়ে দেন। বলেন, ওঁদের দিকে তাকালে আমরা মনোবল পাই। চা-বিরতিতে খেতে খেতে রংপুরের নূরপুরের মেজর রুবানা, ক্যাপ্টেন ফারজানা, মেজর ইসরাত, ক্যাপ্টেন সিফাতের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের মনোবল খুবই উঁচু। তাঁরা জানেন, তাঁরা মিশন করতে এসেছেন। তাঁদের দুজন মুঠোফোনে দেশে থাকা তাঁদের বাচ্চার ছবি আমাকে দেখান।
ব্যানএয়ারও আফ্রিকার গরিব মানুষদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এটার নাম মোনামি হাউজ। সেখানে ২৭ জানুয়ারি দুপুরবেলা দেখা গেল ভিড়। স্থানীয় নারী-পুরুষ-শিশু ভিড় করে সেবা নিচ্ছে।
বাংলাদেশের সৈন্যদের এই যে সেবাব্রত, নিষ্ঠা, পেশাদারি, প্রকৌশলকাজ, বিমানসেবা, চিকিৎসাসেবা, নিরাপত্তা বিধান, অভিযান, সামগ্রিক পরিচালনা, মারাত্মক বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা—সবটা একত্রিত করলে বোঝা যায়, কেন জেনারেল নাকুদে বেরেনা, যিনি আইভরি কোস্টের জাতিসংঘ বাহিনীর কমান্ডার, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের এত প্রশংসা করেন।
লে. ক. জিয়া তাঁর একটা ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সদর দপ্তরে, ২৩ জানুয়ারি। সেটা দেখলাম। বাংলাদেশের মিশন সম্পর্কে তাঁর অনরেকর্ড উক্তি, ‘বাংলাদেশ খুবই প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের কনটিনজেন্টগুলোর পেশাদারি আর অভিযানিক কর্মকাণ্ডে আমরা খুবই সন্তুষ্ট।’
ফোর্স-প্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মান প্রশ্নাতীত, তারা কখনো রুলস অব এনগেজমেন্টের ব্যত্যয় ঘটায় না।’
দালোয়া থেকে আমাদের পরের গন্তব্য মান।
মোনামি মানে বন্ধু। আমাদের গাড়ি একটা ঢালে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থেকে একটা গাড়ি পিছিয়ে আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দিল। আমাদের ড্রাইভার জসিম বললেন, ‘ইউ মোনামি, আই মোনামি, পাদো প্রবলেম।’ ইউ, আই আর প্রবলেম ইংরেজি। ‘পাদো’ মানে ‘নেই’। কথাটা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ‘আমি বন্ধু, তুমি বন্ধু, কোনো সমস্যা নাই।’
আসলেই তো, সবাই যদি সবার বন্ধু হয়ে যাওয়া যায়, তাহলে কোনো সমস্যা থাকে না। বজোঁ মসিঁয়, সুপ্রভাত।

No comments

Powered by Blogger.