শিক্ষার মান এবং অন্যান্য by ড. তুলসী কুমার দাস

এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২৭ জুলাই। পাসের হার গড়ে ৭৫.০৮ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন। আর যদি দেশের শুধু আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যায় সেখানে গড় পাসের হার ৭২.৩৬ শতাংশ।


এই আটটি বোর্ড থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৪ হাজার ৩৮৫ জন। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে গতবারের চেয়ে ০.৫৪ শতাংশ পাসের হার বেড়েছে এবং সেখানে জিপিএ ৫ পাওয়ার হার এ বছর ৫.৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, এ ফলাফল বেশ সন্তোষজনক। কেউ কেউ অবশ্য ফলাফল ভালো হলেও শিক্ষার মান কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার মান নিয়ে এমন সন্দেহ নতুন কিছু নয়। অনেকে বলছেন, শিক্ষার মান আমাদের দেশে নিম্নগামী। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়_কোথাও ঠিকঠাক লেখাপড়া হয় না বলেও অনেকের অভিযোগ। আমার মনে হয়, এই অভিযোগগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। শিক্ষার মান যদি নিম্নগামী হয়, তাহলে শিক্ষার মান আমরা কী কী সূচক দিয়ে নির্ধারণ করব_সেটা আগে ঠিক করা দরকার। যেহেতু এটা নিম্নগামী, তাই এটা ধরে নেওয়া যায়, আগে শিক্ষার মান এখনকার চেয়ে উন্নত ছিল। আসলে কি তা-ই? কতগুলো সাধারণ বিষয় পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট হবে। প্রতিবছরই আমাদের দেশে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাসের হার এবং অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল ক্রমশ বাড়ছে। আবার যদি পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা করা হয় তবে দেখা যাবে, পাঠ্যসূচির কলেবর যেমন বেড়ে চলেছে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি অনেক সমৃদ্ধও হয়েছে। ১০ বছর আগে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা যে পাঠ্যসূচি অধ্যয়ন করেছে, সেটির আকার, বিস্তার এবং গুণাগুণ বর্তমান সময়ে অনেকটা বেড়েছে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানার্জনে আগের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে যাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতেও এটি চলবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত প্রসার এবং জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীদের আরো পারদর্শী করে তুলবে। কাজেই শিক্ষার মান যে নেমে যাচ্ছে, তা বোধ হয় সঠিক নয়।
এইচএসসি পরীক্ষার ফল এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এটিই প্রকৃতপক্ষে উদ্বেগের বিষয়। ভালো ফলে বিমোহিত হয়ে ব্যর্থদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। যারা পাস করতে ব্যর্থ হলো, তাদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের শিক্ষার্থীদের বাংলা এবং ইংরেজি দুটি ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন যথাযথ রাষ্ট্রীয় নীতি। আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও আমরা সেটা উপলব্ধি করেছি। সে জন্য আগের তুলনায় ইংরেজিতেও পাসের হার বাড়তে শুরু করেছে। সন্দেহ নেই, ভবিষ্যতে ইংরেজিতে ফেল করার হার ক্রমশ হ্রাস পাবে।
শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের মধ্যে যে ব্যাপক বৈষম্য বর্তমানে বিদ্যমান_সেটাই দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে, গ্রামের শিক্ষার্থীরা তার ধারে-কাছেও যেতে পারছে না। ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে; এবং তারা প্রতিযোগিতায় শহরের শিক্ষার্থীদের কাছে মার খাচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গ্রাম এবং শহরের প্রায় সমানসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত। গত কয়েক বছরের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ভর্তিকৃত বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এসেছে শহর এবং শহরতলি থেকে। গ্রামের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অতি নগণ্য। অর্থাৎ গ্রামের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে।
দেশে শহরকেন্দ্রিক কিছু স্কুল-কলেজ ছাড়া বেশির ভাগ স্কুল-কলেজে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, মনিটরিং এবং জবাবদিহিতা প্রত্যাশিত স্তরে নেই। গ্রামাঞ্চলের অবস্থাটা হয়তো আরো একটু খারাপ। দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো যে অসংখ্য স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে; সেগুলোয় লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। লক্ষ রাখা দরকার, যেন শুধু শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা গড়ে না ওঠে; বরং এলাকার প্রয়োজনে, শিক্ষার আলো স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ্রামের বেশির ভাগ বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার অবস্থা ভালো নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি অনেক স্কুল-কলেজে লেখাপড়ার মান খুবই হতাশাজনক। শিক্ষক এবং শিক্ষাসংক্রান্ত উপকরণের তীব্র সংকট, অব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা ও তত্ত্বাবধানের অনুপস্থিতি ইত্যাদি সরকারি স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।
আমরা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এক অসহনীয় প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার চাপে কাহিল হয়ে পড়ছে। অভিভাবকরাও মরিয়া হয়ে উঠেছেন_যেকোনো মূল্যে তাদের সন্তানদের ভালো ফলাফল করতেই হবে। অনেক শিক্ষার্থী এ অবস্থার শিকার হয়ে মনোসামাজিক নানা অস্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে লেখাপড়ার চাপের কারণে অন্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিরত রাখতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তাদের সার্বিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই দিকটায় আমাদের এখনই নজর দেওয়া উচিত। তা ছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীরা নানা কারণে সময়ে সময়ে হতাশা, ক্ষোভ, উদ্বেগ ও চাপের মধ্যে পড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় ভেবে জীবনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ফলে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রফেশনাল কাউন্সিলর বা সাইকোলজিস্ট অথবা প্রফেশনাল সোশ্যাল ওয়ার্কার নিয়োগ দিতে পারলে ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছ থেকে পেশাগত সেবা গ্রহণ করে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। স্কুলগুলোতে আগের তুলনায় অধিকসংখ্যক ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে। প্রতিবছরই এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাঠ্যসূচি ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে। ইংরেজিতেও শিক্ষার্থীরা ভালো করতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা অনুশীলন করার প্রবণতা বাড়ছে। এসব বিবেচনায় নিলে বলতে হবে_শিক্ষার মান নিম্নগামী নয়, বরং ঊর্ধ্বগামী। আমাদের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হচ্ছেন। এতদসত্ত্বেও শিক্ষার মানের ব্যাপারে আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা আমাদের নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশ্বপ্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের শিক্ষা হতে হবে বিশ্বমানের! এখনো বহু দূর যেতে হবে আমাদের।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। tulshikumardas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.