বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-সিপিডির সংলাপ : গণতন্ত্রের সংকট ও সম্ভাবনা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

৫ আগস্ট ২০১১ ঢাকায় ব্র্যাক সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত 'গণতন্ত্র ও উন্নয়ন : দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণ' শীর্ষক সংলাপে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। অতিথি বক্তা শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিমা কুমারাতুঙ্গা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা বিদ্যমান বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, সবার অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।


দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সংকটসহ নানা রকম সমস্যা অমীমাংসিত থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তবে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই উন্নয়নে পরিণত করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য মোটেই অমূলক নয়। আমরাও মনে করি, উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই যেকোনো দেশের প্রবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর এর মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয় দেশের সমৃদ্ধি।
চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার দেশ শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক এক মহাসংকট ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছে। তামিল বিদ্রোহীদের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেশটিকে নানা দিকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গণতন্ত্রের জন্য এ চিত্র মারাত্মক প্রতিবন্ধক। যেখানে পরমতসহিষ্ণুতা নেই, সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ একেবারেই দুরূহ। আর্থসামাজিক বৈষম্যও যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের অগ্রগতির বড় অন্তরায়। বৈষম্য সংঘাত অনিবার্য করে তোলে। চন্দ্রিকা ওই সংলাপে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আদর্শিক বিবেচনায় পুরোপুরি যৌক্তিক। কিন্তু এও তো সত্য, শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়ই কেন, বিশ্বের অনেক দেশেই আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য এখনো পর্বতপ্রমাণ। টেকসই গণতন্ত্র ছাড়া যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি পরমতসহিষ্ণুতাও গণতন্ত্রে অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি জরুরি সবার অংশগ্রহণও। গণতন্ত্রে মতভিন্নতা থাকতেই পারে এবং খোলামেলা গঠনমূলক সমালোচনাও গণতন্ত্রের অলংকার বলা চলে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় এর এখনো ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতা বড় ধরনের অন্তরায়; এবং এই অনাকাঙ্ক্ষিত চিত্র বিরাজমান যুগ যুগ ধরে। তা ছাড়া গণতন্ত্রের জন্য এ দেশে কম প্রাণ ঝরেনি, রক্তক্ষরণ কম ঘটেনি। গণতন্ত্রের পথে পথে যেসব বাধা এখনো বিদ্যমান এবং গণতন্ত্রের নামে যে ষড়যন্ত্র এখনো পরিলক্ষিত হয়, তা আমাদের জন্য বড় বিপদচিহ্ন।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের বিকাশে বিদেশিরা পর্যন্ত নানা রকম উপদেশ দিয়ে আসছেন। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি অনেকেই সমস্যার গভীরে কিংবা মূল কেন্দ্রে দৃষ্টি না দিয়ে ঢালাওভাবে সমালোচনাকেই রেওয়াজে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের উল্টো পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছর পরই। রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সেই অপধারা রোধ তো করা তো যায়ইনি, উপরন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও গণতন্ত্রের শত্রুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, পুরস্কৃত করে অশুভ ছায়ার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের বীজ যাঁরা বুনেছিলেন, পর্যায়ক্রমে তাঁরাও আক্রান্ত হলেন। এটিই হয়তো নিয়ম। প্রকৃতির প্রতিশোধ এমনই হয়; যদিও সামগ্রিকভাবে এসবের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুরতা, বর্বরতারই প্রতিফলন ঘটে। ষড়যন্ত্রের জাল থেকে এই রক্তস্নাত বাংলাদেশ আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশাও মুখ্যত এ জন্যই প্রলম্বিত হচ্ছে। অসাধু রাজনৈতিক নেতাদের অপকর্মের দায় বহন করে চলেছে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষ। এই অভিশাপ থেকে কবে আমরা মুক্ত হব_এ এক অন্তহীন প্রশ্ন। অথচ সব রকম নেতিবাচকতার কবর রচনা করেই একাত্তরে এ দেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। কিন্তু ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত শত্রুরা ক্রমেই বলবান হয়ে ওঠে এবং তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যান তথাকথিত কিছু মুক্তিযোদ্ধা। এর সঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর দৃশ্য-অদৃশ্য নানা রকম কারসাজি তো আছেই। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়ই নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তারা বিষবৃক্ষের বীজ বপন করে রেখেছে। টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে এও এক বড় অন্তরায়।
সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এখনো অজস্র কাঁটা বিছানো রয়েছে। নানা রকম বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের চিত্র ভিন্ন এবং সেখানে গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন ধারা বিকাশমান। দুর্নীতিসহ নানা রকম নেতিবাচকতা সেখানেও যথেষ্ট বিদ্যমান। কিন্তু এর প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চারও অনেকেই; এবং দেশের স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। দেশের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে তাঁরা এক মঞ্চে দাঁড়াতে দ্বিধাগ্রস্ত হন না। এই সত্য অস্বীকার করা একেবারেই সম্ভব নয় যে গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে দুর্নীতি ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন সর্বাগ্রে জরুরি। জরুরি সুশাসন নিশ্চিত করা। প্রয়োজন জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা। সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে এসব নিশ্চিত করা দুরূহ। সমস্যা আছে, থাকবে। সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে নয়, বরং সমস্যা মোকাবিলা করার মধ্যেই সমাধান নিহিত। বাংলাদেশে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। আরো বিপজ্জনক হলো, সমাজের বড় একটা অংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশে একাত্ম বোধ করছে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক_কোনো প্রক্রিয়ায়ই তাদের মতামত গ্রাহ্য করা হয় না বলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এও এক বড় ধরনের অশুভ লক্ষণ। অংশীদারি গণতন্ত্রের জন্য স্থানীয় সরকারগুলোর কার্যকর ভূমিকাও নিশ্চিত করা যায়নি। সব কিছুই যেন হয়ে পড়ছে আনুষ্ঠানিকতানির্ভর। উপজেলা নির্বাচন ঢাকঢোল পিটিয়ে হলো বটে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়নের মূলধারায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের কথা এ দেশের সব সরকারই বলে আসছে বটে, কিন্তু কাজের কাজ কে কতটা করেছে, বিদ্যমান বাস্তবতাই তার সাক্ষ্য দেয়। সিপিডির সংলাপে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো রাষ্ট্র পরিচালক, নীতিনির্ধারক ও প্রগতিবাদী সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমলে নেওয়া উচিত। গ্রহণ-বর্জনের স্বাধীনতা যেহেতু অবাধ, সেহেতু ভালোটা তুলে নিতে আপত্তি কী? রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব গিরিশ ঘোষের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।' এই বাণী যুগে যুগে সত্য। আমরা শাসক ও বিরোধী মহলের কুম্ভীরাশ্রু নয়, প্রকৃতই উদার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি চাই। পাশাপাশি চাই দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিএবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা। শাসনের আইন নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলে অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করে তোলা যাবে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রের বড় অলংকার।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.