বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৯৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. এনায়েত হোসেন, বীর প্রতীক অগ্রণী এক প্রতিরোধযোদ্ধা রাতের অন্ধকারে ভারত থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে। তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে আছেন মো. এনায়েত হোসেন। তাঁরা অবস্থান নিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের খুব কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই অপেক্ষা করছেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।


তখন তাঁরা একযোগে আক্রমণ শুরু করবেন। কিন্তু একজন সহযোদ্ধার ভুলে পাকিস্তানিরাই তাঁদের ওপর আক্রমণ চালাল। আকস্মিক আক্রমণে আহত হলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে হকচকিত হয়ে পড়লেন। পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসছে। মো. এনায়েত হোসেনসহ কয়েকজন ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাহসিকতায় থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। এ ঘটনা কামালপুরে। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর।
কামালপুর জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত সীমান্ত বিওপি। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধকালে জুলাই মাসের পর থেকে সেখানে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন পরপর কামালপুরে আক্রমণ চালান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ নভেম্বর গভীর রাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ১৫ নভেম্বর) মুক্তিযোদ্ধারা বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালনার জন্য কামালপুরে সমবেত হন। মুক্তিবাহিনীর তিন কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে কামালপুরের পাশের দুটি গ্রামে (ধানুয়া ও খাসিরহাট) অবস্থান নেন। একটি দল দায়িত্ব পালন করে কাট অব পার্টি হিসেবে।
আক্রমণ শুরুর আগে একদল মুক্তিযোদ্ধা সড়কের ওপর মাইন স্থাপন করেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নির্দিষ্ট সময়ে একযোগে আক্রমণ শুরু করার জন্য নিজ নিজ অবস্থানে অপেক্ষায় ছিলেন। এমন সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র থেকে মিস ফায়ার হয়। তখন রাত আনুমানিক দুইটা। কথা ছিল ভোররাতে আক্রমণ শুরু করার। এদিকে গুলির শব্দে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারা সতর্ক অবস্থাতেই ছিল। পাকিস্তানি সেনারা সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তখন মো. এনায়েত হোসেনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হন।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৫ নভেম্বর সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের (বীর উত্তম ও পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) আহত হন। অধিনায়ক যখন আহত হন তখন মো. এনায়েত হোসেন তাঁর কাছাকাছিই ছিলেন। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
মো. এনায়েত হোসেন ১৯৭১ সালে পঞ্চগড় চিনিকলে চাকরি করতেন। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষ দিকে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. এনায়েত হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৪০৯।
মো. এনায়েত হোসেনের পৈতৃক বাড়ি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম তোসাদ্দেক হোসেন। মা জুলেখা খাতুন। স্ত্রী হামিদা খানম। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.