অকার্যকর মেগাসিটি: ঢাকা কেন নর্দমায় সয়লাব

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর ঢাকা
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের জনাকীর্ণ রাজধানী ঢাকায় নর্দমা পরিস্কারের কাজ করেছেন সুজন লাল। বহু দুর্ভোগের সাক্ষী তিনি। কিন্তু ২০০৮ সালের ঘটনাটা ছিল সবচেয়ে করুণ। একদিনের ভারি বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তাগুলো ডুবে গেছে। সাতজন কর্মী রামপুরায় ম্যানহোল পরিস্কারের কাজ করছে। সাধারণত ক্লিনাররা নর্দমার কোথাও আবর্জনা আটকে গেলে সেগুলো পরিস্কার করার সময় দড়ি ধরে রাখেন যাতে পানির তোড়ে ভেসে না যান। কিন্তু এই গ্রুপটা ছিল নতুন। তাদের জানা ছিল না এ রকম পরিস্থিতিতে কি ধরনের বিপদ আসতে পারে। নর্দমার পানি সেদিন গিলে নিয়েছিল তাদের।
পথচারীরা হাতুরি বেলচা দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে ফেলেছিল। এক পর্যায়ে তিনজনকে পাওয়া গেলো, মৃত। বাকি চারজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। এদের একজন হাসপাতালে মারা যায়। সুজন বললেন, “ওই ঘটনায় আতঙ্ক ভর করে আমাদের মধ্যে। বহু মাস এরপর নর্দমার দিকে তাকাতেও ভয় করতো।”
বাংলাদেশের প্রবল বর্ষার মৌসুমে ঢাকা মাসে কয়েকবার পানির নিচে চলে যায়। ড্রেনগুলোতে অতিরিক্ত চাপ আর শহর নিচু হওয়ায় বাথটাবের মতো সবসময় পানি ভর্তিই থাকে ঢাকা। ঢাকা ট্রিবিউনের মতো পত্রিকাগুলোর পাতা পানিতে ডোবা বাসের ছবিতে ভর্তি হয়ে যায়। শহর বিশেষজ্ঞদের সেই পুরনো অভিমত: ‘আবারও পানির নিচে ঢাকা’ অথবা ‘সেই একই পুরনো অবস্থা’।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় পথচারীদের এমনকি রাস্তার এপার ওপার যেতেও রিক্সা ব্যবহার করতে হয়েছে।
ঢাকা শহরের স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে বর্ষাকালে তা প্রায়ই উপচে পড়ে, ছবি: গেটি ইমেজ
সড়কের পাশে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কাজ করতে বের হয় নর্দমা ক্লিনারদের। অনেকে ম্যানহোলে বাঁশ দিয়ে গুঁতাতে থাকেন। অন্যেরা হয়তো অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে তরল নর্দমার মধ্যে দাঁড়িয়ে খালি হাতে আবর্জনা তুলছে। এই নর্দমার মধ্যে গলাপর্যন্ত ডুবে কাজ করার ছবি বিশ্ব মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর এই ক্লিনারদের কাজকে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজের তকমা দেয়া হয়।
জাতিসংঘ হ্যাবিটেটের মতে, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে ৪৪,৫০০ জনেরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতিদিনই গ্রাম্য এলাকা থেকে আরও মানুষ আসছে। ক্লিনারদের মাসিক রোজগার গড়ে ২২৫ পাউন্ডের মতো। নিজেদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনসংখ্যার ভাড়ে ন্যুব্জ এখানকার অবকাঠামোগুলোকে কোনরকমে ঠেকিয়ে রেখেছেন তারা।
বহু বহু মানুষ, অতি সামান্য সম্পদ
অতিরিক্ত জনসংখ্যা বলতে বোঝায় কোন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের বসবাস। অথবা, বিদ্যমান সম্পদ দিয়ে যত মানুষের জীবন নির্বাহ সম্ভব, তারও অতিরিক্ত মানুষ। এ সব বিবেচনায় ঢাকা একেবারে আদর্শ উদাহরণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশান সায়েন্স বিভাগের প্রজেক্ট ডিরেক্টর অধ্যাপক নুরুন্নবী বললেন, “পৃথিবীতে ঢাকার চেয়েও বড় শহর রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির দিকে তাকান, তাহলে জনসংখ্যার বিচারে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটি।”
অতিরিক্ত ঘনবসতি না থাকলেও শহর ঘনবসতিপূর্ণ হতে পারে। সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দ্বীপ। সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্বও কম নয়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০,২০০ জন। কিন্তু খুব অল্প মানুষই একে অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ বলবে। নাগরিকদের বসতির জায়গা সঙ্কুলানের জন্য বহুতল ভবন গড়া হয়েছে। উপরের দিকে বেড়েছে শহর। অনেক জায়গায় ছাদেও স্কাই-গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে।
জনসংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে ওঠে তখন, যখন বারতি মানুষের ব্যবস্থাপনার আর কোন উপায় থাকে না।
‘বাধ্য হয়ে এ কাজ করছি’
সুজন বললেন, সরকার ঢাকা শহরটাকে ভালোভাবে পরিচালনার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতটা আশা ছিল, ততটা সফল হয়নি তারা। ঢাকার মধ্যভাগে মোটামুটি ধরনের ফ্লাটে পরিবার নিয়ে বাস করে সে। দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছিল সে। পাশেই পানিতে ডুবে থাকা চিপা রাস্তা দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে চলছে রঙচঙা রিক্সাগুলো।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ মুসলিম হলেও সুজনের মতো আরও অনেক হিন্দু রয়েছে এ পেশায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়। এখনও তারা বৈষম্যের শিকার। সুজন আবার দলিত শ্রেণীর হিন্দু। পুরো এশিয়াতেই তাদেরকে দেখা হয় ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে। এবং নিকৃষ্ট ধরনের কাজ করতে হয় তাদের। বাংলাদেশে তাদেরকে ডাকা হয় মেথর নামে। অর্থ হলো যারা বিষ্ঠা পরিস্কার করে।
বর্ষাকালজুড়ে ঢাকায় বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করে, ছবি: এএফপি
সুজন জানালেন, “দাদার সূত্রে অনেকটা উত্তরাধিকারের মতো এ কাজ পেয়েছেন তিনি। অন্য কোন কাজের দক্ষতাও নেই আমার।” সুজন দীর্ঘদেহী, চল্লিশোর্ধ বয়স, লম্বাটে চিকন চেহারা আর ছিমছাম ছাঁটের গোফ রয়েছে তার। “আমার পরিবার চালাতে হয়। বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। সাথে রয়েছে মাসিক ভাড়া আর বিল পরিশোধের চাপ। “আমি বাধ্য হয়ে এই কাজ করছি, যদিও আমি জানি এই কাজ আমার জন্য অসম্মান আর অপমানের কারণ হবে।”
সে জানালো, “পচে যাওয়া বর্জ্যের কারণে নর্দমার নালাগুলো অ্যাসিডিক ও বিষাক্ত হয়ে আছে। তাই ক্লিনাররা শতভাগ নিশ্চিত যে তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা হবেই। বিশেষ করে চর্মরোগ হবেই। প্রায়ই তারা এটা বুঝতেও পারে না। স্থানীয় মদের দোকান থেকে তারা মদ কিনে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে থাকে। ঘুমিয়ে গেলেই দুনিয়া থেকে অন্য জগতে চলে যায় তারা। তাদের জ্ঞান থাকলে হয়তো তারা বুঝতে পারতো, স্বাস্থ্যের কি ক্ষতি হচ্ছে তাদের।”
সবচেয়ে নিম্ন বাসযোগ্য শহর
ঢাকায় বসবাস করা মানেই নানা দুর্ভোগের মধ্যে থাকা। যারা গরিব, তারা গজিয়ে ওঠা বস্তিগুলোতে গাদা করে থাকে, যেখানে সংক্রামক রোগব্যাধি এবং আগুন বাতাসের গতিতে ছড়ায়। ঢাকার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই বস্তিবাসী। মধ্য আর উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে আবার তাদের বড় একটা সময় রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকতে হয়। এই শহর প্রায় নিয়মিত ‘সবচেয়ে নিম্ন বাসযোগ্য শহরের’ তালিকার উপরের দিকে থাকে। এ বছর নাইজেরিয়ার লাগোস এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত লিবিয়া ও সিরিয়ার রাজধানীর পরেই ঢাকার অবস্থান।
আর অনেকটা মজা করে সেটাকেই একটা উন্নতি হিসেবে মন্তব্য করলেন অধ্যাপক নুরুন্নবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অফিসে বসে কথা বলছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটাতে বেশ কিছু গাছপালা থাকার কারণে একটা সবুজ চেহারা পেয়েছে ক্যাম্পাস, যেটা রাজধানীর আর অন্য কোথাও দেখা যাবে না। নিজের বিষয়টাকে অনেকটা হাস্যরস আর আশাবাদের মিশ্রন হিসেবে দেখেন অধ্যাপক নবী। তিনি বললেন, “এই র‍্যাংকিংয়ে কয়েক বছর আমরা এক নম্বরে ছিলাম।”
সব সময় অবশ্য চিত্রটা এমন ছিল না। নবী মনে করার চেষ্টা করলেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার আগে ঢাকায় শূন্য সড়কে পথ চলতে হতো। পুরনো ঢাকায় মুঘল আমলের ক্যানালগুলোতে গোসল করতো মানুষ। ওই এলাকায় এখনও কয়েক শতাব্দি পুরনো বাড়িঘর রয়েছে। যদিও এগুলোর অনেকগুলো উন্নয়নের চাপায় হারিয়ে গেছে। ক্যানালগুলোও ভর্তি হয়ে গেছে। আর সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে নর্দমা নিষ্কাষণের পথগুলো।
পৃথিবীর আরও বহু জায়গার মতোই বাংলাদেশেও দ্রুত, অপরিকল্পিত শহরায়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়ন। সাথে এসেছে গ্রামীণ ও উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়। সে কারণে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ রাজধানীতে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করেছে। এতে প্রচুর চাপ পড়েছে সীমিত সম্পদের উপর। অধ্যাপক নবী বললেন, “আমরা দেখছি গ্রামীণ এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ শহরের দিকে আসছে। মানুষ আসছে তো আসছেই। তাদের বসবাসের জন্য যথেষ্ট আবাসনের ব্যবস্থা কি আমাদের আছে? গরিব মানুষদের বসবাসের জন্য ব্যবস্থা কোথায়?
ঢাকার একজন স্যুয়ারেজ ক্লিনার, ছবি: বারক্রফট
ঢাকায় শহর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ভাগাভাগি হয়ে আছে। নবী বললেন, “সরকারের বিভিন্ন সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এ শহরের দুরবস্থার একটা বড় কারণ।”
দুজন আলাদা মেয়রসহ সরকারের সাতটি দফতর জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করছে। এই জটিলতার কারণে একে অন্যের উপর দায় চাপানোটা সহজ হয়ে গেছে। গত জুলাই মাসে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাইদ খোকন হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে বলেন এ পরিস্থিতির জন্য ওয়াসা দায়ী। কিন্তু তাদেরকে কাজে দেখা যায় না। এর পরপরই খোকনকে দোষারোপ করে ওয়াসা। এর আগে, ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকও বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি এমন প্রশ্নও করেন যে: “কেউ একজন আমাকে বলুন, এর কি সমাধান?”
‘এ জাতির লোকেরা আরও বহু গল্প লিখবে’
কিন্তু অকার্যকর প্রশাসন বাংলাদেশে কাজ সম্পাদনের জন্য সবসময় বাধা হয়ে থাকেনি। এই দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রশংসা পেয়েছে।
কিছু শহরবিদ এখন বস্তিগুলোর ব্যাপারে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে অন্যভাবে ভাবতে চাইছেন। শহরের বিস্তারের ফলে যেহেতু জন্ম হার কিছুটা কমে, তাই তাদের মতে এটাকে খানিকটা সমাধানের অংশও ভাবা যেতে পারে।
অনেকে মনে করেন যে শহুরে এলাকার সীমিত পরিসরে যে সব সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে, সেগুলো পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং সরকারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।
নবী বলেন, “রাজনৈতিক দলের কথা ভুলে যান, কিন্তু এ দেশের মানুষ আরও অনেক গল্প লিখবে। একদিন জনগণ জেগে উঠবে এবং রাজনীতিবিদরা তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবে।”

No comments

Powered by Blogger.