রাজস্ব লুট by খায়রুল হোসেন রাজু

  বাংলাদেশ ব্যাংকের সীলমোহর, চালান ফরম, কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর এবং হিসাব নম্বর জাল করে সরকারী রাজস্বের কোটি কোটি টাকা লুট করছে একটি সিন্ডিকেট।
দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর পরিশোধে আইনী সহায়তার নামে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এদের অপতৎপরতার বিষয়টি একাধিকবার ধরা পড়লেও জালিয়াতি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করেও সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে আইনী সহায়তাকারী এসব প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে তদনত্ম করতে গিয়ে সম্প্রতি জালিয়াত চক্রের রাজস্ব লুট করার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়কর প্রদানে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন সময় আইনজীবীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান সংশিস্নষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পৰ হয়ে সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ কষে বাংলাদেশ ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চালানের মাধ্যমে রাজস্ব জমা দেয়। জমাকৃত চালানের একটি কপি এনবিআরে জমা দিতে হয়। এনবিআর এসব রসিদ দেখে সংশিস্নষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে বলে ধরে নেয়। এর বিনিময়ে আইনী সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানটি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্ধারিত কমিশন আদায় করে। কিন্তু আইন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর চালান ফরম, সীলমোহর, কর্মকর্তার স্বাৰর এবং এ্যাকাউন্ট নম্বর জাল করে সংশিস্নষ্ট ব্যাংকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব জমা না দিয়ে নিজেরাই লুটে নিচ্ছে। তবে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে এনবিআর ও সংশিস্নষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। এতে সরকার একদিকে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে ট্যাক্স প্রদানকারী গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, স্টিল বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড ও দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০০৯ সালের আয়কর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রদান করার লৰ্যে আইনী সহায়তা পাওয়ার লৰ্যে 'দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস' নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে। এরপর ওই প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরম্ন করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের চালান নম্বর ৯/১৯ ও কোড নম্বর ১-১১৪১-০০০০-০১০১ দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামে ৬০ হাজার, ৯/২০ চালানে ওই একই কোড নম্বরে ১০ হাজার, ৯/২১ কোডে ৫৩ হাজার ৯১০ টাকা, ৯/২২-তে ১ লাখ ২৪ হাজার, ৯/২৩-এ ২৫ হাজার, ৯/২৪ নম্বরে ৫০ হাজার এবং ৯/২৫-চালানে ওই একই কোডে দিশা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমাসহ সর্বমোট সাতটি চালানে ৬ লাখ ৮২ হাজার ৯১০ টাকা এনবিআরে জামা দেখায়। কিন্তু প্রকৃতপৰে ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের চালান নম্বর ৯/১৯ কোড নম্বর ১-১১৪১-০০০০-০১১১ শিপ্রা আচার্য নামে ৪ হাজার, ৯/২০ চালানে গেস্নারি এক্সেসরিজ নামে ১ হাজার ৭৪৬ টাকা, ৯/২১ সু-ডাইজেস্ট নামে এক হাজার, ৯/২২-এ আয়নটিক ফ্যাশনের নামে এক হাজার ও ৯/২৩ নম্বরে ওই একই ফ্যাশনের নামে ২ হাজার, ৯/২৪ চালানে টিএ্যান্ডএম ইন্টারন্যাশনাল ২ হাজার এবং ৯/২৫ চালানে ১-১১৪১-০০০০-০১১১ কোড নম্বরে কাজী এনায়েত হোসেন জমাকারীর নামে ৩ হাজার ৬০০ টাকাসহ মোট ১৫ হাজার ৩৪৬ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। এছাড়া ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশিস্নষ্ট কাউন্টারে কার্তিক চন্দ্র প-িত, হালিমা খাতুন এ এম কর্মরত থাকলেও চালানসমূহে রওশন আরা বেগম, আবু তাহের তপাদারের স্বাৰরকারী কর্মকর্তার নাম দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই সময় আবু তাহের তপাদার বাংলাদেশ ব্যাংকের বরিশাল অফিসে কর্মরত ছিলেন। একই সঙ্গে ওই দিন চালানগুলোতে ১-১১৪১-০০০০-০১০১ কোড নম্বরে কোন টাকা জমা দেয়া হয়নি।
এভাবে ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর ট্যাক্স প্রদানের জন্য আইনী সহায়তা প্রদানকারী দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস প্রতিষ্ঠানটি দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ১-১১৪১-০০০০-০১০১ কোড নম্বরে সর্বমোট ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৪ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেখায়। প্রকৃতপৰে ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর ওই কোড নম্বরে কোন অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়নি। ওই একই সময় মোঃ আনোয়ার, বিজনেস কম, মোঃ আলতাফউদ্দিন, হুমায়ুন কবির জমাদানকারীর নামে মোট ১৫ হাজার ৪৫৪ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। এছাড়া ২০০৯ সালের ১৫ জুন স্টিলকোর বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড এবং দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালানে ১ লাখ ২১ হাজার ১৮ টাকা জমা দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়। কিন্তু ওই একই সময় প্রকৃতপৰে মুকিতুর রহমান, রম্নহুল আমীন, মেসার্স সোনালী রবার, পংকজ মৃধা, পলাশ মৃধা, মেহেদী এন্টারপ্রাইজ এবং খাতুনগঞ্জ জমাদানকারীর নামে মোট ৫ হাজার ৩৮৮ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে জমা হয়। এভাবে এ দু'টি কোম্পানি থেকে আইন প্রতিষ্ঠান দৌলা এ্যাসোসিয়েট সর্বমোট ২৩টি চালানের মাধ্যমে সরকারের মোট ১৫ লাখ ১৫ হাজার ২৮১ টাকা লুট করে। এসব টাকা নেয়ার ৰেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালান রসিদ, সীলমোহর, কর্মকর্তার স্বাৰর এবং কোড নম্বর জাল করা হয়। এছাড়া নকল চালান ফরমে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্বাৰর দেখানো হয়, তারা নির্দিষ্ট দিনে অনেকে ছুটিতে ছিলেন। আবার অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরিশালসহ বিভিন্ন শাখায় কর্মরত। এছাড়া অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন না। এভাবে ভুয়া কর্মকর্তার স্বাৰর ও সীল দেখিয়ে এসব টাকা আত্মসাত করা হয় বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদনত্ম কমিটির প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। স্টিল বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড ও দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসের জালিয়াতি বিষয়ক কিছুটা শনাক্ত করেই সামগ্রিক বিষয়টি জানার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। আবেদনের প্রেৰিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি তদনত্ম কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি জালিয়াতির এ বিষয়টি বের করে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র থেকে জানা গেছে।
ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের তদনত্ম কমিটি দৌলা এন্ড এসোসিয়েটের জালিয়াতির প্রমাণস্বরূপ ওই প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এনবিআরকে গত ১৬ ফেব্রম্নয়ারি ২০৫৩ নম্বর চিঠি প্রদান করে। একই সঙ্গে স্টিলকোর বিল্ডিং ও দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকেও ২০৫১ নম্বরে ওই একই সময় চিঠি দেয়া হয়। কমিটির সুপারিশে বলা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কতর্ৃক এইভাবে সরকারী খাতে জাল চালান এনবিআরে জমা দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব লুট করছে। দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট প্রতিষ্ঠানটি তারই প্রমাণ করে।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমি এ বিষয় কিছুই জানি না। এ ব্যাপারে সংশিস্নষ্ট বিভাগের মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করম্নন। মেম্বার (ইনকাম ট্যাক্স পলিসি) মোঃ আমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে চালান আসে সেগুলোকে আমরা সঠিক বলেই ধরে নেই। কিন্তু কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিল, চালান ফরম এবং ব্যাংকের কর্মকর্তার স্বাৰর জাল করে তা এনবিআরে জমা দেয়, তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া আইনী সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি যদি ঢাকা ট্যাক্সসেস বার এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয় তাহলে এনবিআর তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সিল, স্বাৰর এবং চালান ফরম জালিয়াতি করে সরকারের কোটি টাকা রাজস্ব লুট করার বিষয় তিনি স্বীকার করে বলেন, ২০০২ সালেও এ দৌলা প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটায়। কিন্তু কি কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে শাসত্মি হয়নি তা আমি জানি না। তবে শাসত্মি হওয়া উচিত ছিল।
কর জালিয়াতির বিষয়টি জানার জন্য বনানী-কাকলীর ২৭ নম্বর রোডের ৪৫-এ বাড়ির ৩য় ফোরে (সি-৪) স্টিলকোর বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড ও দিশা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের অফিসে ওই কোম্পানি দু'টির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরম্নল আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে স্পষ্ট করে জনকণ্ঠকে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, 'আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটের বিষয়টি নকল প্রমাণিত হয়েছে। এখন এটি এনবিআরে প্রক্রিয়াধীন। নিয়মমাফিক এটি সম্পন্ন হোক আমি চাই। বিষয়টি পত্রিকায় ফলাও করে আসুক তা চাই না। দয়া করে আপনি বিষয়টি লিখবেন না।'
এ বিষয়ে দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের পৰে কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা ট্যাক্সসেস বার এ্যাসোসিয়েশনে গিয়ে খোঁজ করে দৌলা এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটসের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। অবশ্য বার কাউন্সিলের আইনজীবী আব্দুর রহিম জনকণ্ঠকে বলেন, আইন সহায়তা প্রদানকারী কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা একটি সিন্ডিকেট করে সরকার ও গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। আর এর দায় পড়ছে বার কাউন্সিলের অন্যসব আইনজীবীর ওপর। এতে মানুষ আইনজীবীদের প্রতি ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। এটি রোধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তা না হলে সরকার প্রতিনিয়তই মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাবে। আর গ্রাহকরা প্রতারিত হবেন।
অন্য এক কর আইনজীবী সৈয়দ আমিরম্নজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, কিছু কিছু আইন সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সহায়তার নামে সরকারের রাজস্ব লুট করছে। বহু বছর ধরে জালিয়াত চক্রটি তাদের ব্যবসা করলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এসব জালিয়াত চক্রের অফিসের নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা থাকে না। এরা সুযোগ বুঝে কাজ করে। এদের বিরম্নদ্ধে দেশের মানুষের সোচ্চার হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.