ব্রহ্মপুত্রের পারে অপরূপ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় by সোহেল রানা

প্রকৃতি দেখতে কার না ভাল লাগে? তাই তো প্রকৃতির টানে মানুষ ছুটে যায় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে। কিন্তু আমাদের এই রূপসী বাংলায় যে কত চোখ ধাঁধানো রূপ আছে তা হয়ত অনেকেরই অজানা।
ব্রহ্মপুত্রের পারে বসে ওপারের সবুজ প্রান্তরের দিকে তাকালে ওপরের এ রকম হাজারো কবিতার লাইন আপনার মনে উঁকি দেবে। আপনি হয়ে যাবেন একজন পুরোদস্তুর কবি। চলে যাবেন নিজের মনের রাজ্যে। স্বপ্নের মতো শান বাঁধানো নদীরঘাট। এপারে থাকবে হাজারো গাছের ছায়া, ডালে নাম না জানা হাজারো পাখি আর ঐ পাড়টা যেন দূর দেশ। বলছি প্রকৃতি কন্যাখ্যাত কৃষি শিক্ষার তীর্থ স্থান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রকৃতি তার দু'হাত ভরে নির্মল সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়েছে এ ক্যাম্পাসকে। ময়মনসিংহের পূর্বপাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে দাঁড়ালে আপনার মনে হবে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বপ্নের তীরে। জল-তরঙ্গে রচিত হবে আপনার স্বপ্নসিঁড়ি। সবচাইতে বেশি মোহিত হবেন শরতের সময় যখন নদের পাড়ে সাদা কাঁশবনে ফোটে ধবধবে সাদা কাঁশফুল। দেখে মনে হবে সাদা পালকের মুকুট পড়া রাজপুত্র যেন রাজকুমারীর অপোয় প্রহর গুনছে। নদের ক্যাম্পাসের পাশ ঘেঁষে প্রায় দেড় কিলোমিটার ইটে বাঁধানো রাসত্মা। বসার জন্য আছে সিমেন্টের বেঞ্চ। পাশে রয়েছে এক সারি নারিকেল গাছ। বেঞ্চে বসে উত্তরে চোখ পেরম্নলেই-বাংলদেশ চীন মৈত্রী সেতু-২ এবং ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রেল সেতু। ট্রেন সেতু পার হওয়ার সময় মনে হবে এক ঝাঁক পিঁপড়া দলবেঁধে খাবার অন্বেষণে যাচ্ছে আবার খাবার সংগ্রহ শেষে একই পথে ফিরে আসছে। একি এক অপরম্নপ দৃশ্য নদের পাশ ঘেঁষে বৈশাখী চত্বর, উদীচী ঘাঁটের পাশে পাওয়া যায়-প্রেমের তরী টাইটানিক, সোনার তরী, তাজমহল, ভালবাসার ঘরসহ বিচিত্র নামের রঙিন পাল তোলা নৌকা। ঘন্টার পর ঘণ্টা এই নৌকায় নদীর বু্েক ভেসে চললেও মনে হবে না নীড়ে ফিরতে।
ব্রহ্মপুত্রের পাশ ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। সরকারী হিসেব মতে দেশের মোট চারটি বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে সর্বাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই গার্ডেনে। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী সুন্দরবন জোনসহ মোট ৩০টি জোনে বিভক্ত এ গার্ডেনে রয়েছে সহস্রাধিক প্রজাতির উদ্ভিদরাজি। সুন্দরবনসহ (ম্যানগ্রোভ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্ভিদ সম্পর্কে অতি সহজে ধারণা পাওয়া যায় এ গার্ডেনে, যা বিমোহিত করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।
সুন্দরবনের (ম্যানগ্রোভ) আলোকে চারদিকে সিক্ত ও জলবেষ্টিত একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী জোন গড়ে তোলা হয়েছে এ গার্ডেনে যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এ জোনেও সুন্দরবনের ন্যায় সুন্দরী গাছের শ্বাসমূল (নিউমেটাফোর) দেখা যাচ্ছে। এ জোনে রয়েছে বিখ্যাত সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্ণ জাতীয় উদ্ভিদ। যেগুলো একমাত্র সুন্দরবন ছাড়া দেখা পাওয়া সত্যিই বিরল দৃশ্য। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশী-বিদেশী ফুলের মোহনীয় আভায় মুগ্ধ হবেন আপনি।
ফুলের মধ্যে বয়েছে জেসিয়া, সিলভিয়া, হৈমনত্মি, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, ট্যাবেবুইয়া, রাইবেলী, এ্যাস্টার, কসমস, ডায়ান্থাস, রঙ্গন ইত্যাদি। ফলের মধ্যে রয়েছে- স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, কমলা, আঙ্গুর, প্যাসান ফল এবং বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফল। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে- ডেফল, নাগলিঙ্গম, কালাবাস, কারিলিফ, ফলসা, মনহোটা, পেয়ালা, মাক্কি, বনডুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, অর্জুন, বয়রা, হরতকি, কাটাসিংড়া, টিকমা, প্যাপিরাস, রাইবেলী, রম্নপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টোফোরাম ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে দেশী-বিদেশী হাজারো ফুল গাছ। গার্ডেনে প্রবেশের জন্য দর্শনার্থীদের মাত্র ৫ টাকা মূল্যের টিকিট কিনতে হয়।
সম্প্রতি প্রশাসন ভবনের সামনে নবনির্মিত পানির ফোয়ারা সেই সৌন্দর্যে যোগ করেছে নতুন মাত্রা । এখান থেকে একটু পশ্চিমে এগোলেই আপনি পেঁৗছে যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি জমজমাট আড্ডার স্থান জব্বারের মোড়ে। যেখানে বসে ক্যাম্পাসের ছাত্র নেতারা চায়ের কাপে রাজনীতির ঝড় তোলে। এ জন্য এক সময় মোড়টিকে পলিটিক্যাল মোড় বলা হতো। সূযের্াদয় থেকে গভীর রাত পর্যনত্ম চলে ছেলেমেয়েদের জমজমাট আড্ডা। জব্বারের মোড় থেকে যত পশ্চিমে যেতে থাকবেন তত বিস্ময় আরও বাড়তে থাকবে। সারি সারি ছোট-বড় পুকুরে ঘেরা ফিশারিজ মাঠ গবেষণা কমপেস্নক্সের সৌন্দর্যে উৎফুলস্ন হবেন আপনি। এছাড়া রয়েছে দেশ-বিদেশের দুর্লভ সব ফলবৃ েসমৃদ্ধ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফল গবেষণা কেন্দ্র জার্মপস্নাজম সেন্টার। সাড়া জাগানো বাউকুল, আপেল কুল, ড্রাগন ফল, রাম্বুটান, বিভিন্ন জাতের আম, পেয়ারা, জামরম্নলসহ দেখতে পাবেন হরেক রকমের ফলজ বৃ। পাশেই অবস্থিত হর্টিকালচার মাঠ গবেষণা কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ, লেবু বাগান আকৃষ্ট করবে আপনাকে। এ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রয়েছে দেশেরু;টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষনা ইনস্টিউিট (বিনা) এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট (বি.এফ.আর.আই)। এখানে এসে কৃষি ও মৎস্য সমর্্পকৃত বিভিন্ন গবেষনাধর্মী কাজও দেখতে পাবেন আপনি। এছাড়া দেখে আনন্দ পাবেন প্রাচীন কৃষি যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ দেশের একমাত্র কৃষি জাদুঘর, লেক, স্বতন্ত্র গঠন বৈশিষ্টের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলসহ মোট ১১ টি আবাসিক হল। সবুজ শ্যামল ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যে আকৃষ্ঠ হয়ে সপ্তাহের প্রতিদিন বিশেষ করে শুক্র ও শনি বার দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন বনভোজন,শিা সফর,সেমিনার, সমাবেশ কিংবা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য বাকৃবি ক্যাম্পাসে আসছেন। একই সাথে তারা এ ক্যাম্পাসের অপার সৌন্দর্যকেও উপভোগ করছেন। আর তাই সপ্তাহের শুক্র ও শনি বার ক্যাম্পাস থাকে প্রাণবন্ত। বাকৃবিতে এই দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের থাকে বিভিন্ন কর্মসূচী আরেকদিকে ক্যাম্পাসে নানান জায়গা থেকে নানান শ্রেণী পেশার মানুষের আগমন; এ দুই নিয়ে প্রতি শুক্র ও শনি বার ক্যাম্পাসে বসে হাজারো মানুষের মিলনমেলা। তদোপরি,এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিাগত মান এবং মনোরম সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি ডিগ্রী সহ নানা ধরনের গবেষণা করতে চলে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জ্ঞান পিপাসু শিার্থীরা। এখন নিশ্চয়ই আপনারও মন চাইছে প্রকৃতিকণ্যার বুকে কিছু সময় কাটিয়ে যেতে। তাই দেড়ি না করে নগর জীবনের কান্তি আর অবষাদকে পেছনে ফলে কোনও এক ছুটির দিনে চলে আসুন এ সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে। বোনাস হিসেবে পাবেন গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য বিজয়-৭১, শহীদ মিনার,স্মৃতি সৌধ,দেশের এক মাত্র এক গম্বুজ বিশিষ্ঠ মসজিদ, আম বাগান,নারিকেল বাগান,কলা বাগান সহ ছায়া গেড়া রেল লাইন। ভাগ্য ভাল হলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তনে দুই হাজা্র দর্শকের এক জন গর্বিত দর্শক হিসেবে আপনিও উপভোগ কতে পারেন মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনৃষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.