হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে দুশ্চিন্তায় চাষীর মৃত্যু- কাল হলো বাম্পার ফলন

 চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে আলুর বাম্পার ফলন কৃষকের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষক উৎপাদিত আলু নিয়ে হিমাগারগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও আলু সংরণের সুযোগ পাচ্ছে না।
ফলে এ উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আলু নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতির মুখে অনেক কৃষক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই আলুচাষীরা তাঁদের উৎপাদিত আলু হিমাগারে সংরণের জন্য যাচ্ছেন। কিন্তু আলু সংরক্ষণ করতে না পারায় মালিকপরে সাথে সংঘর্ষ, সড়ক অবরোধসহ নানা রকম ঘটনায় কৃষক জড়িয়ে পড়ছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার এক আলুচাষী আব্দুর রহিম হিমাগারে আলু সংরণ করতে না পারায় হিমাগারের সামনেই মৃতু্যবরণ করেন।
প্রানত্মিক কৃষক কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ নয়াটারি গ্রামের মৃত আনছার আলীর পুত্র আব্দুর রহিম (৪৩)। তাঁর উৎপাদিত ১৪ বসত্মা বীজআলু কোথায় সংরণ করবেন এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তিনি দুশ্চিনত্মায় ছিলেন। অবশেষে তিনি রংপুর হারাগাছ সড়কের পাশে 'জেলেমা রহমান' হিমাগারে আলু সংরৰণের জন্য আশ্বাস পান। তাই ওই আলু নিয়ে তিনি গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় ১৪ বসত্মা বীজআলু নিয়ে ওই হিমাগারের সামনে আলু সংরণ করতে আসা কৃষকদের দীর্ঘলাইনে অবস্থান করতে থাকেন। দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা পর বেলা ৫টার সময় ওই হিমাগারের এক কর্মচারী তাঁকে জানান, হিমাগারে স্থানসঙ্কুলান না হওয়ায় তাঁর আলু রাখা যাচ্ছে না। এ সংবাদ শুনে তিনি হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন। ওই আলু নিয়ে কি করবেন? এ দুশ্চিনত্মায় হিমাগারের সামনে হৃদরোগে আক্রানত্ম হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে হিমাগারের ম্যানেজার ফয়জুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি কৃষক আব্দুর রহিমের ১৪ বসত্মা বীজআলু সংরৰণের আশ্বাস দেন। কিন্তু ততণে ওই কৃষকের অবস্থা আরও সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। তাঁকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। এ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই ঘটনাস্থলে হৃদরোগে আক্রানত্ম হয়ে তাঁর মৃতু্য হয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সেখান থেকে তাঁর বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের আত্মীয়স্বজন সেখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরের ৮ জেলায় চলতি মৌসুমে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ ও কৃষকরা বলছেন, ভাল বীজ, চাহিদা অনুপাতে সারের সরবরাহ ও অনুকূল আবহাওয়া এ তিন কারণে এবার উত্তরের কৃষিভা-ার বলে পরিচিত রংপুর-দিনাজপুরের সব জেলাতেই আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। গড়ে প্রতিহেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে আলু উৎপাদিত হয়েছে ২২ মেট্রিক টন। যা বিগত বছরগুলোতে ছিল গড়ে ১৭ থেকে ১৯ মেট্রিক টন। গড়ে প্রতিহেক্টরে ৩ মেট্রিক টন আলু বেশি উৎপাদিত হয়েছে। ৮ জেলার ৫৪টি হিমাগারে আলুর ধারণৰমতা ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৬শ' ৪৫ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়। যার উৎপাদন ফলন হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৪ হাজার ১শ' ৯০ মেট্রিক টন। ফলে হিমাগারগুলোর ধারণৰমতার অনুপাতে ৩৫ লাখ ৪ হাজার ১শ' ৯০ মেট্রিক টন আলু কৃষকরা সংরৰণ করতে পারছে না। এ বিপুল পরিমাণ আলু কিভাবে সংরৰণ করবে তা নিয়ে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। হিমাগারগুলোর সামনে সকাল থেকে রাত অবধি সংরৰণের জন্য আলু নিয়ে এসে কৃষকরা অপেৰা করে স্থানসঙ্কুলান না হওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও কোথাও আলুচাষীদের সাথে হিমাগার মালিক, কর্মচারী ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, সড়ক অবরোধসহ নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কখনও কখনও মহাসড়কগুলোর পাশে আলু সংরৰণের জন্য নিয়ে আসা কৃষকদের ট্রলি, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানের কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ওই যানজট সরাতেও পুলিশ বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত বছর এ সময় যে আলুর বসত্মা ছিল (৮৪ কেজি) ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২শ' টাকা; সেই আলু হিমাগারে রেখে বিক্রি করা হয়েছে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যনত্ম। কিন্তু এবার আলু উত্তোলনের ভরামৌসুমে প্রতিবসত্মা আলু সাড়ে ৩শ' থেকে ৪শ' টাকা পর্যনত্ম পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। যা গড়ে কেজিপ্রতি সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ টাকা পর্যনত্ম দাঁড়িয়েছে। এদিকে হিমাগারে কোন জায়গা নেই। নিরম্নপায় হয়ে কৃষকরা আলুর বসত্মা নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেক কৃষক হিমাগারের সামনে আলু রেখে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও কোন সুযোগ পাচ্ছেন না।

No comments

Powered by Blogger.