অভিমত ॥ ভাষাসৈনিক by ডা. গোলাম মাওলা, আবদুর রহমান ঢালী

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্মেলন উপলৰে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন দম্ভের সঙ্গে আবারও ঘোষণা করলেন উদর্ুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা নাজিম উদ্দিনের এই ঘোষণা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনকে সামনে রেখে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে সারাদেশে সবাত্মক হরতাল ডাকা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাইকযোগে পূর্ববঙ্গ সরকার ২১ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষণা করে। ১৪৪ ধারা জরি করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখ সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদের সভা আরম্ভ হয়। অলি আহাদ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি গোলাম মাওলা, আবদুল মতিন_ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পৰে জোর বক্তব্য রাখেন। এঁদের সমর্থন করেন ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়নের সহসভাপতি সামসুল আলম। ১১-৪ ভোটে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না। ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন যে, আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সভা হবে সে ছাত্র সভায় যদি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পৰে রায় হয় তবে আমরা ভাঙ্গার পৰে। আবুল হাশিম প্রসত্মাবাকারে বললেন যদি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গে তবে স্বাভাবিকভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে। বঙ্গবন্ধু মুজিব তখন জেলে ছিলেন। জেলখানায় তিনি এবং মহিউদ্দিন আহমেদ ১৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে রাজবন্দীদের মুক্তি ও ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে অনশন শুরম্ন করেন। তাদের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। মওলানা ভাসানী সংগ্রাম পরিষদের ২০ তারিখের সভায় ছিলেন না। তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দোদুল্যমানতার কারণ ছিল তাঁরা মনে করতেন ভাষা আন্দোলনের কঠিন অবস্থার মুখে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আপোসকামী সিদ্ধানত্মের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নন এমন কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা ২০ তারিখ দিবাগত রাত ১২টায় ২১ ফেব্রম্নয়ারির জন্য সংগ্রাম কর্মসূচী স্থির করার উদ্দেশ্যে ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে জরম্নরী গোপন বৈঠক করেন। যাঁরা সেখানে ছিলেন তাঁরা হলেন_ ১. গাজিউল হক, ২. হাবিবুর রহমান শেলী, ৩. মোঃ সুলতান, ৪. এম. আর. আখতার মুকুল, ৫. জিলস্নুর রহমান, ৬. আবদুল মোমিন, ৭. এস. এ. বারী এটি, ৮. সৈয়দ কামরম্নদ্দিন হোসাইন, ৯. মঞ্জুর হোসেন, ১০. আনোয়ারম্নল হক খান, ১১. আনোয়ার হোসেন ঐরাতের সিদ্ধানত্ম মোতাবেক পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার বিশাল ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভাংগার ঘোষণা দেয়া হয়। প্রসত্মাব অনুযায়ী সেদিন ছাত্ররা ১০ জনের একেকটি গ্রম্নপ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ শুরম্ন করেন। এর পরই আসে সে মুহূর্তটি যে মুহূর্তে পূর্ববতর্ী সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ সালাম, রফিক, বরকত ও আরও অনেকের বুকের তাজা রক্তে বাংলা মায়ের কাজল মাটিতে আমাদের বাঙ্গালী জাতিসত্তার শিকর হয়। সে রাতেই নতুন করে অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন গোলাম মাওলা। ২২ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় সর্বসত্মরের ছাত্র-জনতা সর্বাত্মক হরতাল ও মিছিল করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে শহীদদের উদ্দেশে জানাজা, শোকসভা ও মিছিল হয়। ২২ ফেব্রম্নয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্ররা বরকত যে স্থানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেছেন যে স্থানে রাতারাতি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধানত্ম নেন। মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী ছাত্র বদরম্নল আলম ও সাইদ হায়দার শহীদ মিনারের একটি চমৎকার ডিজাইন অঙ্কন করে দেন অতি স্বল্প সময়ে, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল ১র্৬ ও র্৬। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি গোলাম মাওলা ও মঞ্জুর হোসেনের নেতৃত্বে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ভোর হওয়ার পূর্বেই নির্দিষ্ট স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ করল। ২৩ ফেব্রম্নয়ারি সকালে সমগ্র ঢাকা নগরীতে এই শহীদ মিনার নির্মাণের কথা মুখে মুখে রটে গেল। সকাল থেকেই ঢাকায় আবালবৃদ্ধিবনিতা দলে দলে এলো এই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবার জন্য। লালসালু কাপড় দিয়ে ঘেরা প্রথম এই শহীদ মিনারের বেদীমূল নানা রঙের ফুলে ভরে উঠল।
ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা যিনি শহীদ মিনার নির্মাণের পুরেধা তিনি আমাদের শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার মোক্তারের চরেরই সনত্মান। তার সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। ১৯৫২-এর আন্দোলনের পথ ধরে ডা. গোলাম মাওলা ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার মোক্তারের চরে ইউনিয়নের পোড়াগাছা গ্রামে এক সম্ভ্রানত্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল গফুর ঢালী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বাবা-মা'র আদরযত্নে লালিত গোলাম মাওলা জাজিরা থানার পাচু খার কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিৰা শেষে করে নড়িয়া বিহারী লাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে মেট্রিক পাশ করে ১৯৪১ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৪৩ সালে বিএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ২য় বর্ষ এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। কলকাতায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ছাত্র রাজনীতিতে অবদান রাখেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শৃঙ্খলিত মানুষের আন্দোলন, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার বীভৎস চেহারা, দেশ বিভাগের পর স্বদেশ ত্যাগী মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, শাসক শ্রেণীর নিপীড়ন অত্যাচার তাঁকে একজন মানবতাবাদী আপোসহীন নির্লোভ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে তাড়িত করেছে। ভাষা আন্দোলনের শুরম্ন থেকে তার সাংগঠনিক দৰতায় তিনি যে উদাহরণ রেখে গেছেন তা তাঁর জীবিত বন্ধুরা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মেডিক্যাল কলেজের ভিপি হিসেবে, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসেবে, পূর্ব পাকিসত্মান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সহসভাপতি হিসাবে সবসময় তিনি সাহসের সাথে সঠিক সিদ্ধানত্ম নিয়েছেন। '৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরম্ন হওয়ার পর থেকে '৫২ সালে আন্দোলনের চূড়ানত্ম পর্ব পর্যনত্ম তার সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা, সততা, সাংগঠনিক ৰমতা, সিদ্ধানত্মে অটল থাকার অঙ্গীকার ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছে এবং চূড়ানত্ম অর্থে সফল করেছে। ১৯৫০ সালে ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তিনি দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেন ১৯৫০ সালের দাঙ্গা হাঙ্গামার বীভৎসতা ডা. গোলাম মাওলার চিনত্মাধারায় একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়। এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরোধে গোলাম মাওলার যে অবদান তার ফলশ্রম্নতিতে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন আরও দৃঢ় ও বলিষ্ঠ রম্নপ লাভ করে। '৫২ এর ভাষা আন্দোলনে গোলাম মাওলার ভূমিকা সম্পর্কে জনাব গাজীউল হক আরও বলেন_
"২০ ফেব্রম্নয়ারিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ড. গোলাম মাওলার ভূমিকা এদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থকবে। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক ডা. সাঈদ হায়দার বলেন, ডা. মাওলা সেই দিন তার প্রতিবাদের মাধ্যমে শুধু ঢাকা শহরের ছাত্রদের নয়, সারাদেশের ছাত্রদের অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে রম্নখে দাঁড়াবার ইচ্ছাকেই প্রকাশ করেছিল। ভাষা আন্দোলনের সেদিনের বিপস্নবী ছাত্রনেতা গোলাম মাওলা ছিলেন ছাত্রদের মধ্যমণি।"
ছাত্রজীবন শেষে ডা. গোলাম মাওলা সরাসরি আওয়ামী লীগে যোগদান করে রাজনীতি শুরম্ন করেন। মাদারীপুরে চিকিৎসা পেশায় নিজেকে নিয়োজিতক রেন। তিনি মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ এবং ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সাধারণ মানুষের ও কমর্ীদের হৃদয় জয় করেছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিসত্মান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। এ সময় পাকিসত্মানের সামরিক প্রেসিডেন্ট আইউব খান তাকে পাকিসত্মানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী করার প্রসত্মাব দিয়েছিলেন। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ডা. মাওলা চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন অত্যনত্ম খ্যাতিমান। সাধারণ মানুষকে তিনি বিনা অর্থে চিকিৎসা দিয়েছেন। নির্লোভ এ ব্যক্তিটি যা কিছু উপার্জন করেছেন তা ব্যয় করেছেন সংগঠনের কাজে ও সেবামূলক কাজে। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন ডাক্তারের ভুলে একজন মানুষের মৃতু্য হয় কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের ভুলে মৃতু্য ঘটে অনেক মানুষের। তাই যারা একবার এ নিরহঙ্কার মানুষটির সানি্নধ্যে এসেছেন তাঁরা সবাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ৬ দফা আন্দোলনে ডা. মাওলার ভূমিকা ছিল অনন্য। আজকে এ অঞ্চলে স্বাধীনতার পৰের শক্তির দৃঢ় অবস্থান তারই ধারাবাহিতা ডা. মাওলা ছিলেন ঐক্যের প্রতীক, ভালবাসার প্রতিক এবং মানবতার প্রতিক। তিনি ১৯৬৭ সালে ২৯ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইনত্মেকাল করেন। এবং তাকে সমাধিসত্ম করা হয় মাদারীপুর জেলার নতুন শহরে। অত্যনত্ম দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভাষাসৈনিক ভাষাশহীদদের সরকারীভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয় নাই।
লেখক : সভাপতি, ভাষাসৈনিক
ডা. গোলাম মাওলা স্মৃতি পাঠাগার।

No comments

Powered by Blogger.