৭ হাজার ভাষা লালনে যাত্রা শুরু করছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট by শাহীন রহমান

প্রায় ৬৫ হাজার বছর চালু থাকার পর সম্প্রতি বিশ্ব থেকে আরও একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী বো উপজাতির শেষ সদস্য বোয়া সিনিয়রের মৃতু্যর মধ্য দিয়ে এ ভাষার মৃত্যু হয়।
বোয়া সিনিয়র ছিলেন এ উপজাতির শেষ সদস্য। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, সংরৰণ, প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ না নেয়া হলে আগামী ৫০ বছরে বিশ্ব থেকে আরও অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এসব ভাষার অনেক ক'টিই প্রায় অব্যবহৃত ও বিলুপ্তির পথে রয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৭শ' কোটি মানুষের মধ্যে ৭ হাজার ভাষা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ভাষা কোনরকমে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি ভাষাগুলো ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। বিশ্বে ১৩টি ভাষা এখন সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গর্বের বিষয় এই যে, এ ১৩টি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অসত্মিত্ব রয়েছে। আর দুঃখের বিষয় যে, প্রধান ভাষাগুলোর মাঝে অবস্থান নিয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহারে চরম অবৰয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাষার অবৰয় রোধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরম্নরী। দ্রম্নত ব্যবস্থা নেয়া না হলে মাতৃভাষা পরভাষানির্ভর হয়ে পড়বে। নিজ ভাষা যদি পরভাষানির্ভর হয়ে পড়ে তা হলে ভাষারৰার উদ্যোগ কোন কাজেই আসবে না।
নিজ ভাষাসহ বিশ্বের অন্যান্য মাতৃভাষা রৰা, লালন, বিকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরম্ন হতে যাচ্ছে। আগামীকাল রবিবার উদ্বোধনের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরম্ন হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। ইতোমধ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাষা ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। শিৰামন্ত্রী নুরম্নল ইসলাম নাহিদ শুক্রবার সরেজমিনে ভাষা ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ভবনের বিভিন্ন তলা ঘুরে দেখেন এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে খোঁজখবর নেন। পরে সংবাদিকদের সঙ্গে সংৰিপ্ত ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী বলেন, ভাষা আন্দোলনের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের কারণে সারাবিশ্বে মাতৃভাষার একটি অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আর এর মূলে রয়েছে বাংলাভাষা আন্দোলন। আনত্মর্জাতিকভাবে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, ভাষা ইনস্টিটিউট জাতির জন্য গর্বের বিষয় হলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট ৬ বছর এর নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছিল। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার কারণে এর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। তাই প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ তলা সম্পন্ন হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরম্নর সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে। আর যাতে এমন গুরম্নত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রতিহিংসার শিকার না হয় সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। সারাবিশ্বে ভাষার যে মর্যাদা সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের রৰা করতে হবে। ভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশ্বে সব ভাষার রৰণাবেৰণের ব্যবস্থা করা হবে। এর মাধ্যমে যাতে সব ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, রৰণাবেৰণে বিলুপ্তপ্রায় ভাষাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
২১ ফেব্রম্নয়ারি আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর তৎকালীন সরকার আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। দীর্ঘ ৬ বছর এর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকলেও বর্তমান সরকার ৰমতায় এসে আবার নির্মাণ কাজ শুরম্ন করে। ইতোমধ্যে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২১ ফেব্রম্নয়ারি উদ্বোধনের পর এর যাত্রা শুরম্ন হবে। জানা গেছে, বিশ্বের মাতৃভাষাগুলোর প্রচার, প্রসার, গবেষণা এবং বিলুপ্ত, বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর উদ্ধার ও সংরৰণের কাজে মূলত ব্যবহার করা হবে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা হবে। সংরৰণের অভাবে বিশ্বের অনেক ভাষাই আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত এ ভাষাগুলো উদ্ধারে সহায়তা নেয়া হবে ইউনেস্কোর মাধ্যমে। ভাষা সংরৰণের জন্য থাকবে আলাদা জাদুঘর। এছাড়াও থাকবে আলাদা আলাদা ভাষা বিষয়ে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম ও ভাষার ইতিহাস সংবলিত আর্কাইভ।
বিশ্বে ভাষা ব্যবহারের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার অবস্থান অষ্টম। প্রায় ২৪ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের ১৩টি সক্রিয় ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান রয়েছে। এ কারণে ভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করা হবে। বহির্বিশ্বের যোগাযোগের ৰেত্রে ইংরেজী ভাষার রয়েছে একচেটিয়া প্রাধান্য। বহির্বিশ্বের ভাষার প্রচার, প্রসার ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাগুলো যাতে অবদান রাখতে পারে সে ব্যাপারেও যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া আনত্মর্জাতিক যোগাযোগে বিভিন্ন ভাষা ব্যবহারের ওপর গুরম্নতারোপ করা হবে। এৰেত্রে আনত্মর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ভাষা বিষয়ে সেমিনার_সিম্পোজিয়াম আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হবে।
ভাষার অবৰয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রৰা করার জন্য থাকবে আলাদা কর্মসূচী। এ কর্মসূচীর আওতায় ভাষার সমৃদ্ধির জন্য গবেষণামূলক কাজের ওপর জোর দেয়া হবে। এর মাধ্যমে বের করা হবে বিভিন্ন প্রকাশনা। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার চেয়ে বাংলা ভাষার রয়েছে আলাদা ইতিহাস। আন্দোলনের মাধ্যমে রৰা করা হয়েছে ভাষার অসত্মিত্ব। নতুন প্রজন্ম ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে বাংলা ভাষার ইতিহাস গুরম্নত্বসহকারে তুলে ধরার ব্যবস্থা এর মাধ্যমে নেয়া হবে। ভাষা আন্দোলন, ভাষার প্রচার, প্রসার ও গবেষণার ৰেত্রে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জানা গেছে, এৰেত্রে বিশেষজ্ঞ গবেষক ও ভাষা শহীদের যথাযথ মূল্যায়নপূর্বক স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। ইউনেস্কোর মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি, তথ্য সংগ্রহের কাজ এবং অন্যান্য ভাষাভাষী বিশেষজ্ঞদের আনত্মর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
আনত্মর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক ও উপ-সচিব আব্দুল মান্নান জানান, আগামীকাল ২১ ফেব্রম্নয়ারি উদ্বোধনের পর এর লৰ্য, উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরম্ন হবে। জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যনত্ম এ প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হবে। প্রকল্পের অধীনে থাকাকালে প্রাথমিক কাজগুলো যেমন লাইব্রেরি, মিউজিয়াম আর্কাইভস ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ সমাপ্ত করা হবে। এরপর ভাষা ইনস্টিটিউটটি সরকারের আলাদা আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। এ আইনবলে লোকবল নিয়োগের পর বৃহৎ পরিসরে কার্যক্রম শুরম্ন করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করছে এর পরিচালনা কাঠামোর ওপর। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, এটি যদি বাংলা একাডেমীর মতো স্বায়ত্তশাসিত হয় তা হলে ভাষার চর্চা ও রৰার উদ্যোগ সফল হবে। আর যদি সরকারীভাবে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় তা হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে কোন কাজেই আসবে না। তিনি বলেন, যার যার ভাষা রৰা করার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। নিজ ভাষা পরভাষানির্ভর হয়ে পড়লে অন্যের ভাষা রৰা করে লাভ হবে না। আগে নিজের ভাষা রৰার দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন কাজে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, অবৰয় ও ধ্বংসের কারণে আগামী ৫০ বছরে বিশ্ব থেকে আরও বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৭ হাজার ভাষার অসত্মিত্ব থাকলেও ৪ হাজার ভাষার কোনরকম ব্যবহার হচ্ছে। বাকি ভাষাগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে।

No comments

Powered by Blogger.