সাত বিদেশী কোম্পানির হাতে ॥ গ্যাস অনুসন্ধান জিম্মি- স্থলভাগের ব্লক ইজারা নিয়ে উন্নয়ন না করায় সঙ্কট তীব্র by রশিদ মামুন

 সাত বিদেশী কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ায় দেশের স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বিঘি্নত হয়েছে। বিদেশী কোম্পানিগুলো স্থলভাগের গ্যাস বস্নক ইজারা নিয়ে কোন উন্নয়ন না করেই যুগের পর যুগ ফেলে রাখায় দেশে গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সংশিস্নষ্টরা বলছেন দেশীয় স্বার্থ রৰায় চুক্তিতে জোরালো শর্ত না থাকায় পার পেয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদারক প্রতিষ্ঠানের উচিত ছিল সময়মতো বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া। কিন্তু তা না হওয়ায় আজ দেশে গ্যাস নিয়ে হাহাকার বিরাজ করছে। তাঁরা বলছেন, সরকার এখন সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বিদু্যত, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এসব বিদেশী কোম্পানির বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়নি। তবে দেশে যেহেতু তীব্র গ্যাস সঙ্কট বিরাজ করছে তাই এসব বস্নকে গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে চাপ প্রয়োগ করা হবে।
বিদেশী কোম্পানিগুলোর গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে সরকার কি ভাবছে জানতে চাইলে খনিজ সম্পদ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন বলেন, তিনি খনিজ সম্পদ সচিব হিসেবে নতুন যোগদান করেছেন। এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
মন্ত্রণালয়ের অন্য এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অতীতের সরকারগুলোর গাফিলতি এবং চুক্তিতে সহজ শর্তের কারণে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ করিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশী এসব কোম্পানি বছরের পর বছর বস্নকগুলো নিজেদের অধীনে রাখার পর অনুসন্ধান কার্যক্রম না করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। বিদু্যত, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ১৯৮৬ সালের পর থেকে গ্যাস বস্নক ইজারা নিয়ে ফেলে রাখার প্রবণতা শুরম্ন হয়েছে। শেলওয়েল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৯৮৬ সালে ২২ ও ২৩ নম্বর বস্নকের ইজারা দেয় সরকার। দীর্ঘ ৬ বছর কোন কাজ না করে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে ইউনাইটেড মেরিডিয়ানের কাছে ২২ নম্বর বস্নক ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু ইউনাইটেড মেরিডিয়ান ইজারা নেয়ার ৫ বছরের মাথায় ২০০০ সালে ২২ নম্বর বস্নকটি ওমান এনার্জির কাছে হসত্মানত্মর করে চলে যায়। ২০০৪ সালে ওমান এনার্জিও গ্যাস বস্নকটিতে কোন কাজ না করে চলে যায়। ২২ নম্বর বস্নকের মতোই অন্যান্য বস্নকেরও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সূত্রমতে, কেয়ার্ন ৫ নম্বর বস্নকের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ১০ নম্বর বস্নক তাদের দেয়া হয়েছিল যার সময়ও শেষ হয়ে গেছে। ১৯৯৩-৯৪ ওকল্যান্ড এবং রেক্সউডের সালে বঙ্গোপসাগরের (কক্সবাজারের পাশে) ১৭ ও ১৮ নম্বর বস্নক ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু তারা কোন অনুসন্ধান কাজ করেনি। একই সঙ্গে দেশের পার্বত্যাঞ্চলের ২২ নম্বর বস্নক ইউএমসিকে ইজারা দেয়া হলেও তারা কোন অনুসন্ধান কাজ করেনি। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর বস্নক শেভরন, ১৭ ও ১৮ নম্বরে টোটাল এবং ৯ নম্বর বস্নক তালেস্নার কাছে ইজারা দেয়া আছে। দীর্ঘদিন পর ১৭ ও ১৮ নম্বর বস্নকে জরিপ কাজ শুরম্ন হয়েছে। এর আগে ১১ ও ১২ নং বস্নকে কোন কাজ না করে ছেড়ে দেয় শেভরন। ১৯৯৮ সালে ৭ নং বস্নকের গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করা হলেও চলতি মাসে দ্বিমাত্রিক সিসমিক সার্ভে শুরম্ন করেছে শেভরন। এক সঙ্গে দীর্ঘদিন বসে থাকার পর ১৬ নম্বর বস্নকের সাঙ্গু গ্যাস েেত্রর কিছু অংশ কেয়ার্ন পরিচালনা করছে।
অনুসন্ধানে জান গেছে, বাংলাদেশে গ্যাসের বাজার তৈরি না হওয়া এবং বিদেশে গ্যাস রফতানির সুযোগ না থাকার কারণে বিদেশী কোম্পানিগুলো ইজারা নিয়ে বছরের পর বছর ফেলে রাখে। অনেক কোম্পানি গ্যাস বস্নক ইজারার কথা উলেস্নখ করে বাজারে শেয়ার ছাড়ে এক সময় প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যায়। প্রায় দু'যুগ ধরে এ গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানিগুলো অচল অবস্থা সৃষ্টি করায় বর্তমানে গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখন গ্যাস সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে আবাসিক ও শিল্প-বাণিজ্য খাতের ওপর। চুক্তিতে দেশীয় স্বার্থ রৰার তেমন সুযোগ না থাকায় বিদেশী কোম্পানিগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন গ্যাসের নতুন উৎপাদন না হওয়ায় সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পেট্রোবাংলার হিসেবেই দেশে দৈনিক গ্যাস ঘাটতির পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। এৰেত্রে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিয়েছে সরকার। চাহিদা মেটাতে তরল গ্যাস আমদানিরও সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে। এদিকে দেশে মজুদ গ্যাসও দ্রম্নত শেষ হয়ে যাওয়ায় সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই- ইলাহী চৌধুরী (বীরবিক্রম) সাংবাদিকদের বলেন, দেশের গ্যাস সঙ্কট নিরসনের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। তবে স্বল্প মেয়াদে সরকার এলএনজি আমদানি করে সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছে। তিনি বিদেশী গ্যাস বস্নক ইজারা বিষয়ে সম্প্রতি বলেছেন তদারক প্রতিষ্ঠানের উচিত ছিল বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এজাজ বলেন, চুক্তিতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতার যথেষ্ট সুযোগ না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো গ্যাস বস্নক ইজারা নিয়ে তা ফেলে রাখার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, গ্যাস সঙ্কট যেহেতু চরম আকার ধারণ করেছে এ জন্য সরকারের উচিত দ্রম্নত পদৰেপ নেয়া। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে চুক্তির ৰেত্রে দেশের স্বার্থ রৰার বিষয়টিতে গুরম্নত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয় বহুল এবং সময়সাপেৰ প্রক্রিয়া। সরকার ইচ্ছা করলে বাপেক্সের মাধ্যমে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে জোরদার করতে পারেন। এ সংক্রানত্ম হাইকোর্টের আদেশটি বাতিল হয়ে যাওয়ায় এখন আর অনুসন্ধান চালাতে কোন বাধা নেই বলে জানান তিনি। গ্যাস ৰেত্রে অনুসন্ধান এবং কূপ খননের আগে বলা সম্ভব নয় সেখানে কি পরিমাণ মজুদ রয়েছে। কিন্তু বিদেশী কোম্পানিগুলো অনুসন্ধান বা কূপ খনন না করেই উত্তোলিত গ্যাস কিভাবে ব্যবহার করা হবে সে আলোচনা করেছে যা যৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, কোন কূপে গ্যাসের মজুদ কম থাকলে সেখানে বিদু্যত কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে সহজেই গ্যাসকে বিদু্যত শক্তিতে রূপানত্মরিত করে দেশের মানুষের জ্বালানি সমস্যা নিরসন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ধীরে ধীরে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠছে। তিনি বলেন, স্থলভাগের পাঁচটি গ্যাস সমৃদ্ধ বস্নকে অনুসন্ধানের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে কাপাসিয়া, সুন্দরপুর, মোবারকপুর ও নেত্রকোনা। আগামী ২ বছরের মধ্যে এসব বস্নক থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সাত নম্বর বস্নকে শেভরন অনুসন্ধান শুরম্ন করেছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এখানে কূপ খনন করা হবে। হোসেন মনসুর বলেন, অতীতে এসব ৰেত্রে অবহেলা করা হলেও এখন আর কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। কেউ চুক্তির শর্ত না মানলে তার বিরম্নদ্ধে পেট্রোবাংলা ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়নি। ৯১-৯৬ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাসের সঙ্কট নিরসনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে পরবর্তী সরকার সে ধারাবাহিকতা রৰা না করায় সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় তেল গ্যাস বন্দর বিদু্যত রৰা কমিটির জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বস্নকগুলো ইজারা নিয়েও কেন তারা এ বস্নকগুলোতে অনুসন্ধান না চালিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখে তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে তেমন কোন পদৰেপ না নেয়ায় কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছে। দেশীয় স্বার্থ রৰার জন্য বিদেশীদের জিম্মি দশা থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.