তরুণ লেখক অমিয়র ইংরেজি উপন্যাস 'উইংস' by নুরুল করিম নাসিম

স্বাধীনতার যেসব অর্জন আমাদের উদ্বেলিত করে তাদের অন্যতম হলো বেশ কয়েকজন লেখক, কবি আমরা পেয়েছি যারা ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস-কবিতা লিখে বিশ্বসাহিত্যের আসরে নিজেদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের অবস্থান কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ণয় করবে সময়, তার নিয়ামক মহাকাল।
কিন্তু এ কথা জোর দিয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এরা আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি গদ্য উপহার দিয়েছেন, নিজের দেশ-মাটি-মানুষ, তাদের স্বপ্ন ও সমস্যা, প্রণয়, চাওয়া-পাওয়া, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, '৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, অভিবাসী জীবন ও সেই জীবনের সংগ্রামময় আখ্যান_ এসবই তাদের লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর আদিব খান তার ঝঊঅঝঙঘঅখ অউঔটঝঞগঊঘঞ উপন্যাসে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী ইকবালের দেশে ফেরার কাহিনী বয়ান করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রকাশনী বইটি ১৯৭৩ সালে ছেপেছে এবং আমাদের সৌভাগ্য বেশ কয়েকটি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই উপন্যাসটি আমাদের দেশেও পাঠকনন্দিত হয়েছে। এরপর, এ পর্যন্ত তিনি আরও তিনটি উপন্যাস বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকার নির্জন ওয়ারীতে, অস্ট্রেলিয়ার একটি কলেজে ঈজঊঅঞওঠঊ ডজওঞওঘএ-এর ক্লাস নিয়ে থাকেন।
অন্য এক কবি
কায়সার হক ইংরেজিতে কবিতা লিখে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বেশ নাম করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।
তাহমিনা আনাম তরুণ প্রজন্মের ঔপন্যাসিক, বাবা মাহফুজ আনাম একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশক। স্বাধীনতার ওপর উপন্যাস ঞযব মড়ষফবহ ঞৎবধংঁৎব লিখেছেন। তথ্যগত কিছু ভুলত্রুটি এ উপন্যাসটিতে থাকলেও গদ্য মন্দ নয়; ভবিষ্যতে এ বিষয়ে যত্নবান হলে আমাদের লেখকদের লেখা ইংরেজি উপন্যাস আরও ব্যাপকতা ও পাঠকপ্রিয়তা পাবে।
আরও অনেকেই গত দু'তিন দশক ধরে ইংরেজিতে লিখছেন; হয়তো তাদের নিয়ে বাংলাভাষায় বা বাংলা দৈনিক ও সাহিত্যপত্রে লেখালেখি না হওয়ার কারণে তারা ভালো লিখেও আড়ালে থেকে যান। বিপুলসংখ্যক পাঠক জানতে পারেন না তাদের বইয়ের খবর।
প্রতিবেশী দেশের একটি পাক্ষিক নিয়মিত বাংলাভাষী লেখকদের এবং সে দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লেখা ইংরেজি বইয়ের পরিচিতি 'বই সমালোচনা' বিভাগে ছেপে থাকে। আমাদের দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে এ ধরনের সংস্কৃতি ও চর্চা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
হঠাৎ শাহবাগের বই বিপণিতে বিদেশি বই খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের তরুণতম অচেনা লেখক অমিয় সদনাম চৌধুরীর 'উইংস' উপন্যাসটি চোখে পড়ল। ১৩৯ পৃষ্ঠার চটি নভেলটি প্রথম দৃষ্টিতেই দু'এক পাতা চকিত দেখেই আকর্ষণ বোধ করলাম। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা সাবলীলভাবে টেনে নিয়ে গেল।
বর্ণনা, গদ্য, উপমা, চরিত্রের উদ্বোধনী আখ্যানের শৈলীতে (ঘঅজজঅঞওঠঊ ঝঞণখঊ) আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে।
এক রাত্রিতে পার্কে অর্ণব হাসানের সঙ্গে দেখা হলো অজিত চৌধুরীর। অর্ণব একজন তরুণ লেখক, তিনি কাহিনীর অন্বেষণে রাত্রিতে পার্কে এসেছেন। এভাবে শুরু হয়েছে আখ্যান।
অর্ণব একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন। তিনি একই সঙ্গে পদার্থবিদও। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন। একজন শিল্পপতিকে তিনি দুটি পাখা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন যার সহায়তায় তিনি আকাশে উড্ডয়ন করতে পারবেন।
ডিটেকটিভ বা থ্রিলারের মতো সাসপেন্স দিয়ে শুরু হলেও কাহিনীতে 'ফ্যান্টাসি' উপাদানও রয়েছে।
তরুণ লেখক অমিয়র সবচেয়ে বড়গুণ তিনি ইংরেজি গদ্যে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। তিনি অবলীলাক্রমে পাঠককে টেনে নিয়ে যান গল্পের গভীরে। কোথাও থামতে হয় না বিদগ্ধ পাঠককে।
ফ্যান্টাসির পাশাপাশি অমিয় স্বপ্নের সহবাস ঘটিয়েছেন। তার বুনন আঁটসাঁট, দৃঢ় ও শক্ত। কোনোভাবেই গল্প কোথাও হেলে পড়ে না। তিনি তথাকথিত উপন্যাস লেখেননি। তিনি একটি আখ্যান বিনির্মাণ করেছেন।
টমাস মান কিংবা মার্কেজ যেমন শব্দের পর শব্দ গেঁথে, বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে একটি বক্তব্য বা সংবাদ যাকে গঊঝঝঅএঊ বলা হয়, অমিয় তা করেছেন।
অমিয়র বর্ণনা টমাস মানের মতো দীর্ঘায়িত নয়; ক্লান্তিও আনে না; কিন্তু নন্দিত পাঠক এমন এক ভুবনে অনুপ্রবেশ করেন, যা আমাদের বাস্তবতা থেকে কোথায় যেন একটু আলাদা, একটু ভিন্নমাত্রার।
অমিয়, শুনেছি আমাদের সমসাময়িক সত্তর দশকের কবি কামাল চৌধুরীর পুত্র। তার ভেতরে জেনেটিকগত কারণেই হয়তো-বা এক কবিসত্তা বিরাজ করে।
সংলাপ চাতুর্যময়, সংক্ষিপ্ত এবং তীক্ষষ্ট। ব্যঙ্গ ও রসিকতাও তার সংলাপে খুঁজে পাওয়া যায়।
সমসাময়িক বাংলা উপন্যাসের ধারা থেকে ভিন্ন সমকালীন ইংরেজি উপন্যাসের গতানুগতিক ধারার কাছেও নিবেদিত নয় অমিয়র 'উইংস'।
এত কম বয়সে, জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা, তিক্ত ও বিচিত্র যেসব অভিজ্ঞতা একজন লেখকের তৃতীয় নয়ন খুলে দেয়, যে ব্যাপক ভ্রমণ ও মানুষকে পাঠ করার অভিজ্ঞতা একজন সফল ও আধুনিক লেখকের প্রয়োজন হয়, সেসব কিছু অমিয়র অর্জনে না এলেও অন্য এক অভিবাসী ঔপন্যাসিক তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'ইন্টারপ্রিটেশন অব ম্যালাডিজ' যে রকম পরিপকস্ফতা বা ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছিলেন, অমিয় তার প্রথম উপন্যাসে বেশ ম্যাচিউরিটির স্বাক্ষর রেখেছেন।
বইয়ের ভূমিকা ও শেষ প্রচ্ছদে লেখকের দুই শিক্ষকের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এর প্রয়োজন ছিল না। অমিয়র উপন্যাস তার নিজস্ব শৈলী ও গদ্যের দৃঢ়তার কারণেই নিজের স্থান করে নেবে। শুধু যা প্রয়োজন, একটু সহানুভূতি দিয়ে তাকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এখানে সেই দুরূহ কাজটি আমি করার চেষ্টা করেছি। আশা করি অমিয় পাঠকের ভালোবাসা পেয়ে লেখায় আরও উৎসাহিত হয়ে নতুন সৃষ্টির পথ খুঁজে পাবে।

নুরুল করিম নাসিম : শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.