সাদাকালো-নারীশিক্ষার আপসহীন যোদ্ধা কিশোরী মালালা by আহমদ রফিক

চৌদ্দ বছরের কিশোরী স্কুলছাত্রী, নাম মালালা ইউসুফজাই। আবাস পাকিস্তান সীমান্তের উপজাতীয় অঞ্চল সোয়াতে। মনে পড়ছে, বিভাগ-পূর্ব সময়ে রমজান মাস সামনে রেখে এক দীর্ঘদেহী পাঠান হাফেজ আসতেন আমাদের শহরে মসজিদে ইমামতি করতে।
তিনি বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলতেন 'সোয়াত স্টেট'। চিঠিতেও তাই লিখতেন। ব্রিটিশ আমলে পশ্চিমের স্বাধীনচেতা উপজাতীয় অঞ্চলগুলো আত্মশাসনের স্বাধীনতা ভোগ করত। চতুর 'রাজ' সরকার হিসাব-নিকাশ করেই তাদের জন্য এটুকু স্বশাসনের ব্যবস্থা রেখেছিল বৃথা ঝামেলা এড়াতে।
পাকিস্তান আমলেও সম্ভবত ওই ব্যবস্থাই চালু ছিল। আর স্বাধীন আফগানিস্তান রাজতন্ত্রী হয়েও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাদ সাধল সমাজ পরিবর্তনের হাওয়া- সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রভাব। শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা ঠেকাতে সোভিয়েত সেনা মোতায়েন আফগানিস্তানে রুশ প্রভাব নির্মূল করতে পাকিস্তানে শুরু হয় ব্যাপক মার্কিন কর্মযজ্ঞ। পরিণামে মাদ্রাসাছাত্রদের (তালেবান) ধর্মের নামে উসকে দিয়ে নাস্তিকদের তাড়াতে যুদ্ধে প্রশিক্ষণ, তাদের মগজ ধোলাই, দেদার ডলার ছড়ানো, ব্যাপক প্রচার এবং তরুণ জঙ্গিদের আফগান যুদ্ধে ব্যবহার। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ধর্মীয় মৌলবাদী ও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী। এ কাজে সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজবাদী একাট্টা। চীন ও ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি আফগানিস্তানে তাণ্ডব সৃষ্টি করে। প্রবল যুদ্ধাবস্থা আফগানিস্তানে।
হটে রুশ বাহিনী। সেই যে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে দুর্দশার শুরু সে অবস্থা এখনো সচল। আফগানিস্তান আঞ্চলিক যুদ্ধের এক উত্তপ্ত কড়াই। এ উপলক্ষে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ এখানে যুদ্ধে লিপ্ত। যে তালেবান যোদ্ধা ও ওসামা বিন লাদেনকে রুশ সৈন্য তাড়াতে ব্যবহার করা হয়, তারাই পরে মার্কিন আধিপত্যবাদী নীতির কারণে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায়। মার্কিন ভূমিকা বুমেরাং হয়ে তাদেরই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোঁড়া জঙ্গিবাদী তালেবান শাসনে আফগান সমাজ মধ্যযুগে ফিরে গেছে। শরিয়া আইন, নির্যাতন ছাড়াও নারী অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। নারীশিক্ষা বন্ধ, তারা গৃহবন্দি। গোটা এলাকা এ ধরনের তালেবানি শাসনে চলেছে। আফগানিস্তানে এখন মার্কিন তাঁবেদারের শাসন। কিন্তু তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই চলছে। এত বছরেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং এর প্রভাব পড়েছে সংলগ্ন উপজাতি এলাকায়। বাদ পড়েনি পূর্বোক্ত সোয়াত অঞ্চল। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের নিম্নবর্গীয়, এমনকি মধ্য শ্রেণীর একাংশের বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে, বিশেষ করে সমাজে। দেখা যাচ্ছে তালেবান নীতির প্রাধান্য।
দুই.
মালালা ঘটনায় ওই তালেবান আধিপত্যেরই প্রকাশ। আগেই বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে তালেবান সন্ত্রাসীদের প্রভাব এত বেশি যে সাধারণ মানুষ সবাই তাদের ভয় করে চলে। তাদের খেয়াল-খুশি যত আপত্তিকর হোক, মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ অবস্থা সোয়াতেও। তালেবানের হুংকারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষও সাহস পায়নি স্কুল খোলা রাখতে। আর তখনই এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সূত্রপাত। একজন সাদামাটা কিশোরী মালালা ইউসুফজাই সাহসে ভর করে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
সবাই এ ঘটনায় অবাক হয়ে যায়। বলতে হয় 'বাপকা বেটি' এবং 'বেটিকা বাপ'। শুধু মালালাই নয়, তার বাবাও প্রতিবাদ জানান। কিন্তু ওই নিঃসঙ্গ প্রতিবাদে কোনো কাজ হয়নি। অগত্যা বুদ্ধিমতী কিশোরী সাহায্য নেয় আধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির। তার তো হারাবার কিছু ছিল না। সে বিবিসির উর্দু ব্লগের সাহায্য নেয়। ভাবতে ইচ্ছা করে পশ্চাৎপদ সোয়াতের এক কিশোরী যদি তার শিক্ষার অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মৃত্যুভয় উপেক্ষা করতে পারে, মরিয়া হয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে পারে, হয়তো কোনো মেধাবী বাঙালি কিশোরী বা তরুণীও এ পরিস্থিতিতে তা করতে পারত।
পারুক বা না পারুক বড় কথা হলো মালালা তা পেরেছে। আমাদের দেশে শিক্ষাবিষয়ক এ ধরনের সমস্যা নেই, তবে অন্য বিষয়ে আছে- যেমন নারী নির্যাতন। আশ্চর্য, তাদের দেখি প্রতিবাদের বদলে হতাশায় আত্মহননে সমস্যার সমাধান খোঁজে। কিন্তু মালালা ঘরে নিজেকে বন্দি করে রাখেনি। মালালা ক্ষোভে-দুঃখে আত্মঘাতী হতেও চেষ্টা করেনি। বরং বলিষ্ঠ প্রতিবাদে ইন্টারনেট-বিশ্বকে জানিয়েছে, 'আমাকে পড়াশোনার অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত করা হবে? মানুষ মাত্রের এ মৌলিক অধিকার আমাকে ফিরিয়ে দাও।' বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ।
এ প্রচারে সুফল দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয়। প্রথম রাউন্ডে শান্ত; ধীর, স্থির মেয়েটির জয়। কিন্তু পরাজয় মেনে নিতে পারেনি অস্ত্রের ক্ষমতায় বেপরোয়া তালেবান সদস্য। তাই তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মালালার প্রতি আক্রমণ চালায়। ওরা বরাবরই অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে। এ ক্ষেত্রে তাই করেছে। স্কুলছাত্রী মালালার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলি মাথায় লাগলেও মালালা প্রাণে বেঁচে যায়।
অশান্ত বিশ্বে এমন অনেক কিছুই ঘটে। আজ কিশোরী, কাল তরুণ, পরশু এক যুবকের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। বাংলাদেশে বছর কয়েক ধরে তা প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে রাজপথে এক তরুণীকে মাস্তানদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে এক সদাশয় ব্যক্তি প্রাণ হারালেন। কাগজে একদিনের খবর হয়ে তিনি বরাবরের মতো হারিয়ে গেলেন। কেউ তাঁর পক্ষে এসে দাঁড়ায়নি। কেউ ভাবেনি তাঁর পরিবারের কী অবস্থা। এ ধরনের একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায় আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে- কোন ভাঙনের পথে আমাদের যাত্রা।
কিন্তু কিশোরী মালালা নিশ্চয়ই পয়মন্তী। তাই পাকিস্তানের মতো ইসলামিয়ানা ও তালেবান-প্রভাবিত দেশেও প্রচারমাধ্যমগুলো মালালার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে নৈতিকতা ও সাংবাদিকতার দায়িত্ববোধ থেকে গ্রহণ করেছে তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি। এমনকি লেখালেখি বিদেশি পত্রপত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে। বিবিসি এদিক থেকে গুরুত্বসহকারে প্রচারের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছে। রাতারাতি মালালা বিশ্বের সহানুভূতি অর্জন করেছে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে তার সুচিকিৎসা, সেই সঙ্গে তাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে, যাতে রক্তপিপাসু তালেবান সদস্যরা তার ওপর দ্বিতীয়বার আক্রমণ চালাতে না পারে।
সুচিকিৎসায় সুস্থ মালালার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম থেকে। বিশ্বজোড়া তোলপাড়। একজন অসম সাহসী কিশোরী শিক্ষার অধিকার রক্ষায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে মরতে বসেছিল- এই প্রচার মালালাকে একজন আদর্শবাদী, সাহসী কিশোরী হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। মালালা নামটি মূলত সাহস ও নিষ্ঠার জন্য এখন একটি 'মিথ' বা 'আইকন'-এ পরিণত, যার মূল কথা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ।
এ অপকর্মের জন্য দায়ী তালেবান গোষ্ঠী এখন কোণঠাসা অবস্থায়। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাদের এ বিষয়ে তাই সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে মালালা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ট্র্যাডিশন তৈরি করে ফেলেছে এবং এর প্রভাব এতটাই যে রক্ষণশীল দেশ পাকিস্তান পর্যন্ত মালালাকে জাতীয় শান্তি পুরস্কার দিয়ে নিজেদের মুখ রক্ষা করেছে, এমনকি বিদেশি প্রভাবশালী মহলে ভাবনা চলছে তাকে বৃহত্তর কোনো পুরস্কারে ভূষিত করা যায় কি না।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র মহল মালালা ইস্যুটিকে যথাযথ গ্রহণ করেছে খবরে ও প্রতিবেদনে এবং ফিচারে। তাকে নিয়ে উপসম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে একাধিক দৈনিকেও। ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় প্রভাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবাদপত্র ও অন্য প্রচারমাধ্যম প্রকৃতপক্ষে জাতীয় কর্তব্য পালন করেছে। তবে ধন্যবাদ জানাতে হয় বিবিসি ও অন্য প্রচারমাধ্যমগুলোকে, যারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ায় মালালা ইস্যু এতটা জনহৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছে। আমাদের সমাজে মালালা ঘটনা শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে।
মালালা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তবে সুস্থ হওয়ার পথে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রমনা মানুষের প্রত্যাশা, মালালা ইউসুফজাই নামের কিশোরী শিগগিরই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। লেখাপড়ার সঙ্গে চালিয়ে যাবে নারীশিক্ষার পক্ষে তার প্রচার, যা আন্দোলনের তুল্য। কিন্তু সোয়াত অঞ্চল এ ব্যাপারে এখনো পশ্চাৎপদ অবস্থায়, মূলত সমাজে তালেবানি প্রভাবের কারণে। তা না হলে কি মালালার তিন সহপাঠীকে তাদের পরিবারসহ সোয়াত ছাড়তে হয়? এ অবস্থার পরিবর্তন সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না।
না, ঘটার কারণ তালেবানি উত্থান। যে উত্থানের পেছনে মূল শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র। অতীতের ঘটনার জন্য তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। পাকিস্তানসহ গোটা আফগান অঞ্চলে যে সহিংসতা চলছে, দ্রুতই তার অবসান ঘটবে বলে মনে হয় না। মার্কিন সেনা অপসারণের পক্ষে ওবামার ঘোষণা সত্ত্বেও ঘটবে না। কারণ তালেবান যোদ্ধারা এতটাই শক্তিশালী যে তারা সে শূন্যস্থান পূরণ করবে বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। অন্ধকার সংলগ্ন উপজাতীয় অঞ্চলগুলোরও ভবিষ্যৎ।
এর প্রভাব পড়ছে পাকিস্তানেও, যদিও পাকিস্তানের সংবাদসেবী মহল আধুনিক চেতনার দিকে এক পা বাড়িয়ে। কিন্তু তাতে কী হবে? পাকিস্তানে তালেবানি প্রভাব কতটা, তার প্রমাণ তাদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডগুলো থেকে। বাঁচতে পারেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। এই তো কয়েক দিন আগে গণতন্ত্রী সাংবাদিক হামিদ মিরের গাড়ির নিচে বোমা রাখা হয়। নেহাত ঘটনাক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে মালালা 'ফ্যাক্টর'ও থাকতে পারে।
সত্যি বলতে কি, কথাটা যত অপ্রিয় শোনাক পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যবাদীরা তমসাচ্ছন্ন করে দিয়েছে। এ কাজে সবচেয়ে বড় অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে তার দোসররা। পাকিস্তানি সমাজও তাই কবে যে গণতান্ত্রিক চেতনায় ফিরবে, বলা কঠিন। গুটিকয়েক মানুষের কণ্ঠস্বর নিঃসঙ্গ হয়েই থাকছে। এ অবস্থায় সোয়াত আলোর পথ দেখবে কিভাবে! মালালা ইউসুফজাই কবে ফিরতে পারবে সোয়াতে বলা কঠিন।
তবে এ সাহসী কিশোরী আমরা আশা করব তার প্রতিবাদী যাত্রা অব্যাহত রাখবে। সম্প্রতি বিশ্ববাসীর প্রতি তাকে সমর্থনের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে মালালা। গণতান্ত্রিক বিশ্ব, প্রগতিবাদী বিশ্বও তার পাশেই আছে, তাকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে প্রসারিত ভবিষ্যৎ। সময় তাকে একদিন গড়ে তুলবে এক আপসহীন সমাজসেবী নারীযোদ্ধা হিসেবে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.