ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডিঃ গ্রেপ্তারের জন্য আসামীদের অফিসে চিঠি দিয়ে ঠিকানা খুঁজছে পুলিশ by রমেন দাশগুপ্ত

নগরীর চান্দগাঁও থানার বহ্দ্দারহাট সংলগ্ন শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের বহদ্দার পুকুর পাড়ে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে হতাহতের ঘটনায় মামলা দায়েরের ১১দিন পরও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এমনকি পুলিশ মামলার ২৫ আসামীর মধ্যে মাত্র চারজন ছাড়া বাকি আসামীদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও সংগ্রহ করতে পারেনি। এ অবস্থায় পুলিশ আসামীদের অফিসে চিঠি পাঠিয়ে তাদের স্থায়ী ও বর্তমান সহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে চেয়েছে।

নগরীর চান্দগাঁও থানার ওসি বাবুল বণিক বাংলানিউজকে বলেন, `আমরা প্রাথমিকভাবে আসামীদের নাম ও পদবি দিয়ে তাদের মামলায় অর্ন্তভুক্ত করেছি। এখন তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ করছি যাতে গ্রেপ্তারে সুবিধা হয়। কয়েকজনের ঠিকানা পেয়েছি। বাকিদের অফিসে চিঠি দিয়ে তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে চেয়েছি।`

আসামীদের কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে তাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে চাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তারে এখন পুলিশের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। আসামীরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গ্রেপ্তার করছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মিরাজ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, `আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছিনা। যাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া গেছে তাদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। বাকিদের ঠিকানা পেলে তাদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলবে।`

গত ২৪ নভেম্বর রাতে সিডিএ`র নির্মাণাধীন এ ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়। এ ঘটনার দু`দিন পর ২৬ নভেম্বর রাতে নগরীর চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) আবুল কালাম আজাদ বাদি হয়ে ২৫ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলায় সিডিএ`র তিন কর্মকর্তাকে আসামী করা হয়েছে। এরা হলেন, ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএ`র নির্বাহী প্রকৌশলী এ এ এম হাবিবুর রহমান, সিডিএ`র সহকারী প্রকৌশলী তানজিব হোসেন ও উপসহকারী প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।

মামলায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার এন্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমস (জেভি) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক সহ ১০ জনকে আসামী করা হয়। বাকি ৯ আসামী হলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রকল্প পরিচালক হোসাইন আহমেদ পান্না, পরিচালক (প্রশাসন) মো.শাহজাহান, প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, সুপারভিশন ইঞ্জিনিয়ার মনজুরুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মো.রিয়াজ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার শাহজাহান আলী।

মামলায় বেসরকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটস এন্ড ডিপিএম`র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিন সহ ১২ জনকে আসামী করা হয়। বাকি ১১ আসামী হলেন, পরিচালক সৈয়দ আফছার হোসেন, আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান, সুপারভিশন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ও অরূপ বিশ্বাস, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিয়া এবং প্রকল্প পরিদর্শক বায়েজিদ মীর কামাল, হুমায়ন কবির, সাইদুর রহমান, সোহেল হাসান, তৌহিদুর রহমান ও তারেক মাহমুদ।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান চান্দগাঁও থানার ওসি (তদন্ত) রেজাউল করিম। কিন্তু গত ১১ দিনে গুরুত্পূর্ণ ও স্পর্শকাতর এ মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। গত ১১ দিনে তদন্তকারী কর্মকর্তা শুধু আসামীদের ঠিকানা সংগ্রহেই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ওসি বাবুল বণিক বাংলানিউজকে বলেন, `জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মোকাবেলায় আমাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে। তার উপর হরতালের ডিউটি করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তদন্তের কাজে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি চোখে পড়ছেনা।`

মামলার এজাহারে যে ২৫ আসামীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন ছাড়া আর কারও স্থায়ী কিংবা বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করতে পারেনি পুলিশ। শুধুমাত্র অফিসের ঠিকানা উল্লেখ করেই মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সিডিএ`র যে তিন কর্মকর্তাকে আসামী করা হয়েছে তাদের পদবির পাশে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, থানা-কোতয়ালী, চট্টগ্রাম।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রাজ্জাকের ঢাকার বাসার ঠিকানা উল্লেখ করতে পেরেছে পুলিশ। ওই ঠিকানা হচ্ছে, সাব্বির টাওয়ার, ৩/৪-এ পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।

এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাকি যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের নামের পাশে মীর আক্তার এন্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমস (জেভি) এর ব্যবসায়িক কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিকানাটি হচ্ছে, হাউজ নং-১৩, রোড নং-১২, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা-১২০৯।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের সবার নাম ও পদবির পাশে এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটস এন্ড ডিপিএম এর কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিকানাটি হচ্ছে, মিশন নাহার (থার্ড ফ্লোর), হাউজ নং-৬০, রোড নং-১৮, ব্লক-জে, বনানী, ঢাকা-১২১৩।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাবিহীন ২৪ আসামীর মধ্যে গত ১১ দিনে তদন্ত করে পুলিশ শুধুমাত্র আসামীর তালিকায় থাকা সিডিএ`র তিন কমকর্তার পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা উদ্ধার করতে পেরেছে। বাকি ২১ আসামীর অফিসের ঠিকানায় তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে চিঠি দিয়েছে পুলিশ।

মামলার এজাহারে ঠিকানা উল্লেখ থাকা আব্দুর রাজ্জাক কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি এবং ঢাকায় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আব্দুর রাজ্জাকের বাসার ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও গত ১১ দিনে তার বাসায় পুলিশ কোন অভিযান চালাতে যায়নি।

এমনকি আসামী হবার পরও আব্দুর রাজ্জাক বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিলেও পুলিশ বলছে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় আব্দুর রাজ্জাকের ঠিকানা জানা স্বত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোন অভিযান পরিচালনার সাহস করেনি পুলিশ। আর সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের একান্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারেও অদৃশ্য রাজনৈতিক চাপের কারণে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, `সিডিএ`র তিন প্রকৌশলীকে আমরা যথেষ্ঠ খুঁজেছি। তারা চট্টগ্রামে নেই। আর আসামীদের গ্রেপ্তারে চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। ঢাকায় থাকা আসামীদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলবে।`

No comments

Powered by Blogger.