মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কী বিস্মৃত হয়েছি? by শামসুল আরেফিন খান

মহান একাত্তরের মুখ্য আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা কী ছিল? মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ অর্জনই বা ছিল কী? মনে হয়, আমরা বিস্মৃত হয়েছি সে কথা।
আজ পাকিস্তানের যে বর্বর সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের বহ্নিশিখা হয়ে বিশ্বনন্দিত হয়েছে বালিকা সাহসিকা মালালা ইউসুফজাই, আমরাও সেই জালিম সমাজের বিরুদ্ধেই ২৪ বছর লড়েছি।
৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও শ্লাঘা লালন ও বহন করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার ছিল- ১. আমরা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদমুক্ত, হানাহানি-হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত একটি নিরঙ্কুশ সেক্যুলার রাষ্ট্র ও শান্তিময় সহাবস্থানের নিরুপদ্রব বহুমাত্রিক সমাজ গঠন করব; ২. দৃঢ় পদক্ষেপে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যাব। কিন্তু আমাদের সে প্রত্যাশা, প্রতীতি ও প্রত্যয় নিদারুণ সব ব্যত্যয়ের অভিঘাতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিরঙ্কুশ হয়নি। সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার দৃপ্ত অঙ্গীকার পূরণের সুযোগ পাননি জাতির জনক। সংখ্যালঘু দুর্বল জনগোষ্ঠী নাগরিক জীবনের সম-অধিকার ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আদিবাসীর অধিকার ও ঐতিহাসিক স্বীকৃতি লাঞ্ছিত ও লঙ্ঘিত হয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী এক দীর্ঘ সময় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নাগরিকরা নির্বিঘ্নে-নিরুপদ্রবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। অপশক্তির ভাড়াটিয়া অস্ত্রধারীরা তাদের বসতিতে বউ-বেটি তুলে নিয়ে যাওয়ার হুংকার ছেড়ে বোমা ফাটিয়ে সন্ত্রাস করেছে। তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি। ভোটকেন্দ্রে ব্যালট কেড়ে নিয়েছে। ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই করেছে। কয়েক যুগ ধরে হত্যা, ধর্ষণসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এমন সব কদর্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে যে লাঞ্ছিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা জেনেভার আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন- আমাদের সামনে দুটি মাত্র পথ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে- ১. ধর্মান্তরিত হওয়া ২. দেশ ত্যাগ।
মনে পড়ে, ভারত বিভাগের পর অপরিণামদর্শী মুসলিম লীগ নেতারা বলতে শুরু করেছিলেন, 'পাকিস্তান কেবল মুসলমানদেরই আবাসভূমি। ভারতের চরদের এখানে জায়গা হবে না।' তার জবাবে ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী বল্লবভাই প্যাটেল বলেছিলেন, 'ঠিক আছে, হিন্দুদের যদি পাকিস্তানে বসবাসের সুযোগ না থাকে, তাহলে তারা হিন্দুস্তানে চলে আসুক। আর হিন্দুস্তানের মুসলমানরা চলে যাক তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমিতে। ১০ কোটি লোক চলে গেলে এক-দেড় কোটি লোককে জায়গা করে দেওয়া আমাদের জন্য কোনো সমস্যাই হবে না।' ভয় পেয়েছিলেন জিন্নাহ সাহেব। ভূতের মুখে আমরা রামনাম শুনতে পেয়েছিলাম। জিন্নাহ বলেছিলেন, এখন থেকে মুসলমান কিংবা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখব না। আমাদের একটাই মাত্র পরিচয় হবে- আমরা সবাই পাকিস্তানি। কিন্তু পরে দেখা গেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তিনি বাঙালির ভাষা শুধু নয়, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত হলেন। ভাষা হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রাম যাতে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে না পড়ে বা দাবানল হয়ে না ওঠে, সে লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুন জ্বালানো হলো। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা হিন্দু সুশীল সমাজ দেশান্তরী হলো। সেই সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার সক্রিয় বামপন্থী নেতা-কর্মী অসহনীয় বৈরিতার মুখে মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হলো। বায়ান্নর মহান ভাষা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে সাধিত ব্যালট বিপ্লবে ভীত হয়ে কায়েমি স্বার্থের বরকন্দাজরা ১৯৫৮ সালে ঠাণ্ডা মাথায় গণতন্ত্রকে জবাই করল। সংবিধান পদদলিত করে স্বৈরদানব আইয়ুব খান পাকাপোক্তভাবে সিংহাসন দখল করলেন। ১৯৬৪ সালে আবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিশাপ নেমে এলো স্বৈরশাসনের ইন্ধনে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নেতা-কর্মীরা বুক দিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করলেন। শান্তির পতাকা হাতে রাজপথের মিছিলে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারও সেদিন। মিছিলে শান্তিকর্মী নজরুল প্রাণ দিয়েছিলেন। অধ্যাপক অজিত গুহ ও গওহর জামিলসহ লেখক, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেকেই আমরা দৈনিক ইত্তেফাক ভবনে এনে নিরাপত্তা দিতে পেরেছিলাম। সক্রিয় হয়েছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম- তখনকার বরেণ্য দৈনিক ইত্তেফাক, আজাদ, সংবাদ, অবজারভার পত্রিকার খ্যাতিমান চার সম্পাদক। 'পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও' ব্যানার শিরোনামে সব সংবাদপত্র একই ভাষায় গর্জে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংখ্যাত দানবীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি তখনই আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল কায়েমি স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৯৭১ সালে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে তারাই হানাদার বাহিনীর দোসর হয়ে নারকীয় তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল। একাত্তরে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়েছিল তারা। নিশ্চিহ্ন হয়নি। তাদের পুনরুত্থান ঘটল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেই অপশক্তি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নারকীয় হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে সাম্প্রতিককালেও বিষাক্ত ছোবল হেনেছে দিনাজপুর, সীতাকুণ্ড, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট প্রভৃতি স্থানে নিরীহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। কুখ্যাত শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল হওয়ায় তাদের প্রচণ্ড গাত্রদাহ হয়েছে।
এখন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য একাত্তরের হন্তারক, ধর্ষক ও লুটেরাদের সুষ্ঠু বিচার কার্যক্রম চলছে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। এই বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে সমাজের শিরায় শিরায় ও প্রবাসে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও তাদের নব্য জঙ্গি দোসররা। একাট্টা হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে মিয়ানমারের হরকাতুল জিহাদ, আল-ইসলামী আরাকান, লস্কর-ই-তৈয়বা, আল-কায়েদা, হিযবুত তাহ্‌রীর, হুজি বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি সংগঠন। অভিযোগ আছে, তারা বিশেষ একটি ব্যাংকের সহায়তায় আইএসআইয়ের অর্থায়নে নাইক্ষ্যংছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম গিরি শিখরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির গড়েছে। আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি গড়ে একটি মিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই নাকি তাদের আশু লক্ষ্য।
মিয়ানমারের দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ আরাকান রাজ্যে রয়েছে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান। তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় পরিচয় নেই। তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পায়নি। সে দেশের ১৩৫টির মতো নৃতাত্তি্বক উপজাতীয় গোষ্ঠীর একটি হিসেবেও মেনে নেওয়া হয়নি তাদের। রাখাইন বৌদ্ধদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের নিরন্তর প্রচেষ্টার কথা কারো অজানা নয়। কিন্তু ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ কখনোই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে বৈশ্বিক ঐতিহ্যে মেনে নেয়নি। এটা মিয়ানমারের ঘরোয়া সমস্যা। সমাধানও তাদেরই দায়িত্ব। বাংলাদেশ বরাবরই এ কথা বলেছে।
বাংলাদেশের ০.৭ শতাংশ নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় কাতারে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তারা। একাত্তরের দুঃসময় ব্যতীত বিগত ৬৫ বছরে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কখনোই হুমকির মুখে পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ করে কেন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সর্বদলীয় মুসলমানরা একসঙ্গে নাড়া দিয়ে রামু পটিয়া উখিয়া টেকনাফের বৌদ্ধ শান্তিকুঞ্জে দক্ষযজ্ঞ ঘটাল তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখা দরকার। অন্তরালের ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের কঠোর হাতে দমন ও আইনে সোপর্দ করা দরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। ষড়যন্ত্রকারী হঠকারীদের দলীয় পরিচয়ও জাতিকে নির্দ্বিধায় জানতে হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে তিন যুগে সৃজিত বর্ধিত লালিত একটি অপশক্তি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শিকড় গেড়েছে। ঘটনাস্থলে তাদের সম্ভাব্য অপতৎপরতাকে মহাজোট সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি উপদ্রুত এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষা করতে। ব্যর্থ হয়েছি অহিংস দেবতার পবিত্র মন্দিরের পূত অস্তিত্ব হেফাজত করতে। আমানত খেয়ানত হয়েছে। এ লজ্জা আমার আপনার সবার। এ লজ্জা সমগ্র জাতির। দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতীদের মূলোৎপাটনে ব্যর্থ হলে তার জন্য আমাদের জাতি হিসেবেই অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক, নির্বাহী সভাপতি সেক্যুলার ইউনিটি বাংলাদেশ
miktisakhan@yahoo.com; facebook-shamsularefeen khan

No comments

Powered by Blogger.