বাংলাদেশের পোশাক কারখানার শোকাবহ ঘটনা থেকে শিক্ষা by মেরি কে. হেনরি

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে যে কালো স্তূপ তৈরি হয়েছে, সেই অগ্নিকাণ্ডে ওয়ালমার্ট, ডিসনি, ডিকিজ, সিয়ান, কম্বস এবং সিয়ার্স কম্পানির জন্য তৈরি করা কাপড়ের টুকরোর সঙ্গে পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছে ১১২ জন পোশাক শ্রমিক। এই আগুনের দৃশ্য ছিল মর্মান্তিক।
মনে করিয়ে দিয়েছে ১০০ বছর আগে নিউ ইয়র্ক সিটিতে ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখার কথা, যাতে ১৪৬ জন গার্মেন্ট শ্রমিক জীবন দিয়েছিল।
বাংলাদেশে এই আগুন লাগার ঘটনায় দেখা গেছে, শ্রমিকরা ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যরা এমনভাবে পুড়ে গেছে, যাদের আর চেনার উপায় নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা সর্বসমক্ষে জানিয়েছেন, আগুনের সংকেত বেজে ওঠার পরও যাঁরা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। এমনকি যাতে শ্রমিকরা বের হতে না পারে, সে জন্য গেটগুলো আটকে দিয়েছেন। যে ভয়, আতঙ্ক বাংলাদেশের এসব শ্রমিকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তা অকল্পনীয়। যে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই কুখ্যাত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং যারা কারখানা থেকে লাভ তুলে নেয়, তাদের দায়িত্ব গ্রহণে নির্লজ্জ অনীহা সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত। কম্পানি কোড অব কনডাক্ট এবং শিল্পকারখানাবিষয়ক মনিটরিং সংগঠনগুলোর এসব মনিটর করার এবং সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা। কিন্তু তারা সেটা করে না। ওয়ালমার্ট, ডিকিজ, সিয়ান, কম্বস এবং সিয়ার্স ইতিমধ্যেই সমবেদনা ও শোক প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং ভাবখানা এমন যে তারা ভবিষ্যৎ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বেলায় যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারগুলোর উচিত এমন উদ্যোগ নেওয়া, যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক আইনের আওতায় শ্রমিকদের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়; যাতে আন্তর্জাতিকমানের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আইনগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়। আমেরিকার জনগণের বলা উচিত (যেহেতু ওখানকার কারখানাগুলোতে উৎপন্ন দ্রব্য আমাদের বাজারে বিক্রি হয়) যে খুচরা বিক্রেতা এবং পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে বাংলাদেশ ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি অ্যাগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করতে হবে, যা ইতিমধ্যেই কেলভিন ক্লাইন এবং টমি হিলফিগারের প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ করপোরেশন গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ও শ্রম অধিকারবিষয়ক এনজিওগুলোর শুরু করা এই চুক্তি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত করপোরেট প্রোগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি সুদৃঢ়। এই চুক্তির শর্তে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ দ্বারা তদারকি, তদারকি রিপোর্ট প্রকাশ, জরুরি সংস্কার কাজ, জরাজীর্ণ ভবনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, যা ভয়াবহ ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করবে। এর মধ্যে হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এই চুক্তিতে ব্র্যান্ডগুলোকে সেসব সরবরাহকারীর সঙ্গে ব্যবসায় নিষেধ করা হয়েছে, যারা প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ করতে এবং নিরাপদ কাজের নিশ্চয়তা দিতে অপারগ।
কিন্তু এসব হলো সবই সমীকরণ। শ্রমিকরাই তাদের কথা সবচেয়ে ভালো বলতে পারে। চুক্তির শর্তে সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তার ব্যাপারে শ্রমিক এবং ইউনিয়নের মুখ্য ভূমিকার বিষয়টি নিশ্চিত করে। চুক্তির কারণে সব কারখানায় শ্রমিকদের নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা কমিটি হতে পারে। এই ইউনিয়নের মাধ্যমেই শ্রমিকদের জানা সম্ভব, তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা কী করে তারা নিজেরাই নিশ্চিত করবে এবং কী করে তারা অনিরাপদ কাজের পরিবেশকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখে। এই মৃত্যুর হার ক্রমেই বাড়তে থাকবে যদি সরকারগুলো এবং বড় বড় ক্রেতা কম্পানি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয় এবং যতক্ষণ শ্রমিকদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে কথা বলতে ইউনিয়ন করতে না দেওয়া হয়। বাংলাদেশের এই ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের পর আরো একটি কারখানায় আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে কেউ হতাহত হয়নি। ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট কারখানার সেই অগ্নিকাণ্ড গোটা অমেরিকাকে নাড়া দিয়েছিল এবং আমেরিকার শ্রমিকদের কর্মস্থল নিরাপদ করার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আমরা এখন শুধু আশা করতে পারি, তাজরীন গার্মেন্টের অগ্নিকাণ্ড একরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে শুধু বাংলাদেশের গার্মেন্টশ্রমিকদের জন্য নয়, সব জায়গার শ্রমিকদের জন্য।
লেখক : সার্ভিস এমপ্লয়িজ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের হাফিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধটি
ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.