সংবাদ বিশ্লেষণ-জামায়াতের দুঃখ কেবল দূতাবাসের গাড়ির জন্য কেন?

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী। দুই মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবিরের মারমুখী সদস্য ও সমর্থকদের ঝটিকা হামলা চলছে।
আপাতদৃষ্টিতে এসব হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য পুলিশ বাহিনী, তবে সাধারণ মানুষও রেহাই পাচ্ছে না।
বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন, তাঁদের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীতেও দফায় দফায় হামলা করা হয়েছে পুলিশের ওপর। আইনমন্ত্রীর গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। সব শেষে মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালেও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মারমুখী ভূমিকায় দেখা গেছে দলটির সদস্য ও সমর্থকদের। এ দিনও পুলিশই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্ধশতাধিক গাড়িতে হয় ভাঙচুর, না হয় আগুন লাগানো হয়েছে। হরতালের আগের দিনও ঢাকায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
এসব হামলায় আহত ব্যক্তিদের প্রতি কোনো সমবেদনা জানায়নি জামায়াত। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, ব্যাপকভাবে যানবাহন পোড়ানো বা ভাঙার জন্য কোনো অনুতাপ বা অনুশোচনাও নেই তাদের। অবশ্য বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতিতে নেই এটি। এ সরকারের আমলে প্রথম হরতাল ডাকার আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কৈফিয়ত দিয়েছিলেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। পথচারীদের কাছে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন তাঁরা হরতাল ডাকতে বাধ্য হয়েছেন; মানুষের অসুবিধার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সে দৃষ্টান্ত ছিল ওই একবারই।
রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের ক্ষেত্রে এবার নতুন উদাহরণ তৈরি করল জামায়াত। মঙ্গলবার হরতালের দিন রাজধানীর খিলক্ষেতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একটি গাড়িতে হামলা চালায় সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকরা। সন্ধ্যায় সংগঠনটি এ হামলার দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ তো করেই, পাশাপাশি ক্ষতিপূরণেরও প্রস্তাব দেয়। দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেন, '...অভূতপূর্ব এ দুঃখজনক ঘটনার ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্ত শেষে এর দায়দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করছি এবং নিন্দা জানাচ্ছি।...'
গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও চালক 'সামান্য' আহত হয়েছেন উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবও দেওয়া হয় এতে। সকালে ওই হামলার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তীব্র নিন্দা এবং হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে জামায়াতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল বলে দূতাবাসের এক মুখপাত্র জানান।
জামায়াত হয়তো ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেরাই তদন্ত করে ঘটনার দায়দায়িত্ব নিয়েছে। এতে বোঝা যায়, জামায়াত কারো কারো আহ্বানে সাড়া দেয়, দায়িত্বশীল আচরণ করে। কিন্তু ওই দিনই তাদের কর্মী-সমর্থকরা ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপকভাবে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। গত দুই মাসে এ ধরনের ঘটনায় আরো অনেক গাড়ির ক্ষতি হয়েছে, পুলিশ ও সাধারণ মানুষও আহত হয়েছে। মঙ্গলবারের হঠাৎ ডাকা হরতালে এলোমেলো হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার সময়সূচি। ব্যাহত হয়েছে শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবিকা। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে না পেরে রাস্তায় মারা গেছেন শরীয়তপুরের শেফালী।
কিন্তু কারো জন্য কোনো মায়া নেই জামায়াতে ইসলামীর। কোনো দুঃখ প্রকাশ নেই, অনুশোচনা নেই। ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব নেই। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওই গাড়িতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাঁরাও কিছুটা আহত হয়েছিলেন। হামলায় গাড়ির সামনের ও পেছনের কাচ ভেঙে গেছে। পুলিশের ধারণা, গাড়িটি হঠাৎ হামলার শিকার, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের গাড়ি বলে নয়। যাহোক, তবু জামায়াত দায় স্বীকার করেছে। দেশব্যাপী তাদের কর্মীরা যে ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে, এর দায় কি তাদের নেই? একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে দলটি যে জঘন্য মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছে, এর দায় স্বীকার করে নিয়ে দলটি তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সহায়তা করবে কি? তাতেও যদি তাদের পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়!

No comments

Powered by Blogger.