তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ গত বছরের তুলনায় ২৪ ধাপ নিচে- দুর্নীতি-পরিস্থিতির অবনতি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি ধারণাসূচক ২০১২ অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় নিম্নক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। গত বছরও তাই ছিল। আর উচ্চক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪। গত বছর ছিল ১২০তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২৪ ধাপ নিচে নেমেছে।
অর্থাৎ দেশে দুর্নীতি-পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে, শেয়ারবাজার, হল-মার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, দখল, ক্ষমতাশালীদের সম্পদের হিসাব না দেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা খর্ব ও দুদকের বিতর্কিত অবস্থান এবং ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার দুর্নীতিকে উদ্বেগজনক অবস্থায় নিয়েছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিআইয়ের দুর্নীতিবিষয়ক বৈশ্বিক জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৭। এবারের স্কোর ২৬, অর্থাৎ স্কোর এক কমেছে। স্কোর কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ থেকে কমে ১৪৪-এ এসেছে।
গত বছর টিআই ১৮৩টি দেশের তথ্য দিয়েছিল। কোনো দেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক জরিপ থাকলে সেই দেশের তথ্য টিআই ব্যবহার করে। এ বছর ১৭৬টি দেশ সম্পর্কে এমন জরিপ পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র মানুষ। দুর্নীতি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। দেশের অগ্রগতিকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের স্কোর এক পয়েন্ট কমেছে এবং অবস্থান ২৪ ধাপ নেমেছে। কাজেই এ কথা বলা যায় যে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে।
টিআই বলছে, ২০১২ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। এদের প্রতিটির স্কোর ৯০।
৮ স্কোর পেয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে সোমালিয়া, উত্তর কোরিয়া ও আফগানিস্তান। সোমালিয়া সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে ছয়বার। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার নিম্নে অবস্থান করছিল।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিছু ক্ষেত্রে দুদকের অবস্থানে সরকারের অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন, প্রশাসন রাজনীতিকরণ, কালোটাকা সাদা করার অব্যাহত সুযোগ, দুর্বলতর সরকারি ক্রয় বিধিমালা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ ও দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে। তিনি বলেন, এ ছাড়া জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও জরুরি। এই সনদের সহায়তায় আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ সফল হয়েছে।
অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি তো বিএনপি অস্বীকার করছে—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সুনির্দিষ্ট ঘটনায় সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১২ নির্ণয়ে টিআইবির কোনো ভূমিকা নেই। টিআইবির কোনো গবেষণা তথ্যও এতে ব্যবহার করা হয়নি। এ বছরের জরিপে ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে তথ্য নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সাতটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়েছে টিআই। সেগুলো হচ্ছে: বার্টেলসমান ফাউন্ডেশনের ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইটের কান্ট্রি রিস্ক রেটিং, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেসের ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পারফরম্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক্সিকিউটিভ অপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অব ল ইনডেক্স। জানুয়ারি ২০১১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১২ সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করা তথ্য সূচক নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।
ধারণা সূচকের বৈশ্বিক প্রকাশ হলেও সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের তথ্য, অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জানানো হয়। তাতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উচ্চ ক্রমানুসারে ষষ্ঠ ও নিম্ন ক্রমানুসারে দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে থাকা ভুটানের স্কোর ৬৩, দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ৩৩। সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানের স্কোর ৮, দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১৭৪।
শ্রীলঙ্কা ও ভারতের স্কোর যথাক্রমে ৪০ ও ৩৬। দেশ দুটির অবস্থান ৭৯ ও ৯৪। পাকিস্তান ও নেপালের স্কোর সমান, ১৭। দেশ দুটির অবস্থান ১৩৯। ন্যূনতম তিনটি উপাত্ত উৎস না থাকায় মালদ্বীপকে ২০১২-এর সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
আফগানিস্তান ছাড়াও বুরুন্ডি, হাইতি, ইকুয়্যাটরিয়াল গিনি, জিম্বাবুয়ে, লিবিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, তাজিকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইয়েমেন, গিনি, কিরগিজস্তান, গিনি-বিস্যাউ, প্যারাগুয়ে, ইরিত্রিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, সিরিয়া, কঙ্গো রিপাবলিক, ইউক্রেন—এসব দেশের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে।
টিআই মনে করে, দুর্নীতি হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেআইনি কাজ। এটি মারাত্মক বৈশ্বিক সমস্যা। কোনো দেশই ১০০ স্কোর পায়নি। ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১২৪টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে। বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩, গড়ের চেয়ে কম স্কোর পেয়েছে ৬৭টি দেশ। দুর্নীতি ও ঘুষের প্রবণতা, সরকারি তহবিল আত্মসাৎ, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় অবৈধ অর্থ সংগ্রহ—এ ধরনের তথ্য ধারণা সূচকে ব্যবহার করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.