রোহিঙ্গা সংকট-শুভ চিন্তার জয় হোক by শামসুল হুদা

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অতীতের ব্রহ্মদেশ (বার্মা), বর্তমানে পরিবর্তিত নাম মিয়ানমার। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বাংলাদেশ সংলগ্ন তাদের রাখাইন প্রদেশ। আগে নাম ছিল আরাকান। এই রাজ্য তথা রাখাইন প্রদেশে শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে।
দেশটিতে অনেক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে অর্ধেক বর্মি জনগোষ্ঠী এবং এককভাবে দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সম্পদের মালিক। দেশটিতে বর্মিপ্রধানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সংগ্রাম করে আসছে দীর্ঘদিন। এ প্রদেশটিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগুরু হলো রাখাইনরা এবং বৃহত্তম সংখ্যাগুরু রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গারা যখনই তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে দাবি উঠায়, তখনই তারা নির্যাতনের শিকার হয়। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে সরকার তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পাঁয়তারা করে থাকে। মিয়ানমার সরকার নতুনভাবে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। অথচ চারজন রোহিঙ্গা ১৯৯০ সালে সে দেশের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পার্লামেন্টে নির্বাচিত হওয়াটা তাদের জন্মগত ও অর্জিত অধিকার হিসেবে চিহ্নিত। রোহিঙ্গারা মুসলমান হওয়ায় তাদের 'বাংলাদেশী অভিবাসী' আখ্যা দিয়ে মিয়ানমার সরকার বারবার বেআইনিভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি করছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়ে আসছে। কিন্তু এভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশের পক্ষে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশ যৌক্তিক কারণে নতুনভাবে শরণার্থী গ্রহণে অসম্মতি জানাতে বাধ্য হচ্ছে।
কয়েক মাস আগে একজন বৌদ্ধ মহিলার সঙ্গে মুসলিম রোহিঙ্গার অবৈধ সম্পর্কের গুজব রটনাকে কেন্দ্র করে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাখাইন বৌদ্ধরা নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায়। রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়নের উদ্দেশ্যে এটা একটা পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। এতে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছে সরকারি মদদপুষ্ট রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতায় এদের লক্ষ্য ছিল মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়া। রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা অর্ধাহারে, অনাহারে রোগাক্রান্ত জীবনযাপন করছে। কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধ রাখাইন গোষ্ঠী আগ্রহী এনজিওদের রোহিঙ্গাদের মধ্যে সেবাকার্য ও ত্রাণকার্য পরিচালনায়ও বাধা দিচ্ছে। এভাবে মানবাধিকার বঞ্চিতদের ব্যাপারে মিয়ানমার আন্দোলনের নেত্রী ও নোবেল শান্তি বিজয়ী অং সান সু চির চোখের সামনে এসব ঘটনা চলতে থাকলেও তিনি চুপচাপ। বরং তার সাম্প্রতিক সফরে ভারতের এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার দেশের সামরিক জান্তার মতো একই সুরে রোহিঙ্গাদের 'রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী' হিসেবে উল্লেখ করেন এবং আরও মন্তব্য করেন যে, তার দেশের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ এবং মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী প্রেরণ বন্ধ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের বংশপরম্পরায় সে দেশের স্থায়ী অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সম্পর্কে অং সান সু চির মতো একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর পক্ষে এ ধরনের অবাস্তব ও অচিন্তনীয় বক্তব্য বিশ্বের সচেতন মানুষের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। সু চির মন্তব্যের অসারতা একটা কথায়ই প্রমাণ করা যায় যে, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী গত কয়েকশ' বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে, অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে ১৯৭১ সালে। সুতরাং রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত এ জনগোষ্ঠীকে কোনোক্রমেই বাংলাদেশের নাগরিক বলার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি মিয়ানমার সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যা বিশেষ গুরুত্ব পায়। ওবামা রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের ওপর উৎপীড়ন চালানোর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। যে কোনো মূল্যে সেখানে চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।' ওবামা আরও বলেন, 'রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় যে হতাহত ও অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেদিকে এখন আমাদের দৃষ্টি রয়েছে এবং আমরা সেখানকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছি।' নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না উল্লেখ করে ওবামা মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের উদ্দেশে বলেন, 'আপনার এবং আমার যে আত্মসম্মান আছে, ঠিক একইভাবে রোহিঙ্গাদেরও আত্মসম্মান আছে।'
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সফরের প্রাক্কালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সে দেশের প্রেসিডেন্ট থেইনের কিছুটা নমনীয় মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবকেও তিনি রাখাইনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এক চিঠি লিখেছেন বলে জানা গেছে। ওই চিঠিতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কিছু নতুন অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতির কথাও উল্লেখ করেন। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বসহ অন্যান্য স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে এবং বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই প্রেসিডেন্ট থেইনের।
মিয়ানমারের সমাজের শীর্ষ পর্যায়ে এখন রাজনৈতিক সংস্কার তথা গণতান্ত্রিক সংস্কারের যে উদ্যোগ এসেছে এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার সফরে দেশটির সংস্কার কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০১৫ সালে হতে যাচ্ছে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। এটা দেশটির একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সামরিক জান্তার সরকারের অবস্থা নির্ণীত হবে। ক্ষমতায় যেতে হলে অধিক ভোট পেতে হবে। এটা সেইন ও সু চি দু'জনেরই চিন্তা। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তারা দু'জনই বিপাকে বলে মনে হয়। রোহিঙ্গাদের পক্ষে ন্যায়ভাবে কিছু বললে দু'জনেরই সংখ্যাগুরুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টির মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালের বাণিজ্য অবরোধ অবসানের পথে অগ্রসর হওয়া, অন্যদিকে একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুরুদের সমর্থন হ্রাসের আশঙ্কা। তাদের এ চিন্তাভাবনাকে মানবতাবিবর্জিত স্বার্থান্বেষী মনোভাব বলে আখ্যায়িত করা যায়। দেখা যাক, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও অং সান সু চি এই উভয় সংকট কীভাবে অতিক্রম করেন। তবে এ সংকট উত্তরণে সঠিক চিন্তার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক কর্মপন্থা গ্রহণ তাদের দেশের জন্য অতি জরুরি। বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সচেতন মানুষের প্রত্যাশা, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দীর্ঘদিনের অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন ও অমানুষিক নির্যাতনের অবসানকল্পে দু'জনেরই শুভ চিন্তার উদ্রেক হবে এটাই তাদের দেশের জন্য মঙ্গল।

শামসুল হুদা :ভাষাসংগ্রামী

No comments

Powered by Blogger.