দিনভর নাটকীয়তাঃ বিশ্বব্যাংক ও দুদকের তিন বিষয়ে দ্বিমত by আদিত্য আরাফাত

তিন দিনে তিন দফা বৈঠক করেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। নাখোশ হয়ে ঢাকা ছেড়েছেন লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, তিনটি বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সঙ্গে দ্বিমত হয় দুদকের। এর প্রথমটি, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কোনো অভিযোগ না থাকা।

প্যানেলের দ্বিতীয় অভিযোগ, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান টিম মামলার সুপারিশ করলেও কমিশন কোনো কারণে তা বাদ দেওয়া। তৃতীয় কারণ, এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা কানাডিয়ান নাগরিক কেভেন ওয়ালিস, রমেশ সাহা ও মো. ইসমাইলের নামে মামলায় আসামির সুপারিশ করা।

মঙ্গলবারই নয়জনকে আসামি করার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের প্যানেল অবগত হয়।

বুধবার প্যানেল দুদকে আসলে জানানো হয়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির দালিলিক কোনো তথ্য না পাওয়া যাওয়ায় তাকে মামলার আসামি করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে মামলা করলে তা যুক্তিযুক্ত হবে না। দুদকের একজন কমিশনার একথা বিশেষজ্ঞ দলকে জানান। এ বিষয়ে ঘোর আপত্তি তোলে প্যানেল। আন্তর্জাতিক এ দলের পক্ষে ওকাম্পো জানিয়েছেন, যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালীন আবুল হোসেন এ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। মূলত এসএনসি লাভালিনকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দিতে তিনিই সহযোগিতা করেছেন।

এরপর আপত্তি তোলেন মসিউর সম্পর্কে। প্যানেল দুদককে জানায়, উপদেষ্টা ড. মসিউর ছিলেন পদ্মাসেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার। এ প্রকল্পের সবকিছু তার নখদর্পণে ছিল। দুর্নীতির যে চেষ্টা হয়েছে, তাতে তিনি সরাসরি যুক্ত না থাকলেও এসএনসি লাভালিন যে অবৈধভাবে কাজ পাচ্ছেন তা তিনি জানতেন। কাজেই তার বিরুদ্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, এসময় দুদকের পক্ষে পাল্টা বলা হয় ড. মসিউর রহমান পদ্মাসেতুর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

প্যানেল আরো আপত্তি তোলে, দুদক যে আসামির তালিকা তৈরি করেছে সেখানে কানাডিয়ান নাগরিক এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভেন ওয়ালিস, রমেশ সাহা ও ইসমাইলকে আসামি রাখা হয়। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক প্রশ্ন তোলে, তারা বিদেশি নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে কানাডিয়ান আদালতে বিচার চলছে। রমেশ ও ইসমাইলকে কানাডা পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। তারা বর্তমানে জামিনে আছেন। একই অপরাধে একই লোকের দুইবার বিচার হতে পারে না।

জানা গেছে, প্যানেলের অনেক যুক্তি মেনে নেয়নি দুদক। তারা বলেছে, আবুলের বিরুদ্ধে মামলা করলেও দালিলিক প্রমাণ না থাকায় আদালতে এ মামলায় হারবে দুদক।

নানা নাটকীয়তায় ঢাকায় প্যানেলের শেষ দিন
নানা নাটকীয়তায় কেটেছে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দ্বিতীয় সফরের শেষদিন।

ইস্কাটনের হেয়াররোডে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ফের সন্ধ্যা সাতটায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আসে লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ দল। পাঁচ মিনিট দুদকে অবস্থান করে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিচে নামেন।

দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান ওকাম্পো তদন্ত ও মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করেই চলে যান।

ওকাম্পো বলেন, “দুদকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা এখানেই সমাপ্তি টানছি।”

তদন্ত ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন, “আমরা এখন এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।”

দুই দফা ঢাকা সফর করলেও এই প্রথম সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন ওকাম্পো। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন প্যানেলের অন্য দুজন সদস্য হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক প্রধান টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড অফিসের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অ্যাল্ডারম্যান।

এর আগে লুইস গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ দল ৩টা ৪০ মিনিটে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। পৌনে ৪টায় শুরু হয় বৈঠক। সাড়ে ৪টায় হঠাৎ বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টাইন দুদকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, “অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য আমরা যাচ্ছি। একটু পর ফিরে দুদকে আসতে পারি।” এরপর প্যানেল দুদকে আসলেও গোল্ডস্টাইন আসেননি।

গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টাইন জানিয়েছিলেন, বুধবার তাদের অবস্থান তুলে ধরবেন। কিন্তু দুদকে প্যানেল আসলেও বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিনিধি সন্ধ্যায় আসেননি।

‘বিশ্বব্যাংক নয়, সকল সিদ্ধান্ত দুদকের’
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানিয়েছেন, অনুসন্ধান ও মামলার বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত দুদকের।

মামলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কোনো মতবিরোধ হয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। আপনাদের (সাংবাদিকদের) একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বলি, সিদ্ধান্ত হবে দেশের আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী। বিশ্বব্যাংক কি বলল, প্যানেল কি বলল তা আমরা শুনব, বিবেচনা করব। শেষ সিদ্ধান্ত দেশীয় আইন অনুযায়ী হবে।”

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা কবে হচ্ছে এ বিষয় জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আইনি ব্যবস্থার বিষয়টি দু’একদিনের মধ্যে বিবেচনা করব। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।”

তিনি জানান, কিছু বিষয় দুদক নতুন করে পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনা করবে।

বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্যানেল তাদের ভিউ পয়েন্টস বলেছে। আমরাও আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি। তারাও ভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে।”

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দুদকের সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্ট হয়নি প্যানেল। বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ, আবুলের বিরুদ্ধে যেন আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অন্যদিকে, দুদকের একটি পক্ষ চাইছে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেহেতু ঘুষ লেনদেনের দালিণীক তথ্য পাওয়া যায়নি, তাই তাকে মামলা থেকে রক্ষা করার।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বুধবারের এ বৈঠকের ওপরই নির্ভর করছে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে কি, করবে না। প্যানেল যদি এ প্রকল্পে দুদকের অনুসন্ধান সুষ্ঠু ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে প্যানেল অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে জানাবে।

মূলত, দুদকের প্রতিবেদনের ওপর এখন নির্ভর করছে দেশের ভাবমূর্তি। আশংকা করা হচ্ছে, এ প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত শনিবার রাতে ঢাকায় আসে বিশেষজ্ঞ দল। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার দুদকের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা।

প্যানেলের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধান টিমের যে চার সদস্য ছিলেন তারা হচ্ছেন, এ প্রকল্পের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক আবদুল্লা-আল-জাহিদ, মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম।

উল্লেখ্য, পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন। পরে সরকার অভিযোগ তদন্তে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর।

জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি ফিরে গিয়ে তাদের প্রতিবেদন দেবে। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গৃহীত আইনি পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না হলে আবারও সংকটে পড়বে পদ্মাসেতু প্রকল্প।

সাংবাদিকদের কাছে আবুলের ফোন
বুধবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিবেদকসহ দুদকে বিটে কর্মরত বিভিন্ন সাংবাদিকদের ফোন করেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “আমি নির্দোষ। আপনারা সত্য লিখুন। আপনারা বিবেকবান।”

এসময় আবুল বলেন, “বিদেশের লোকজন এসে দেশের নির্দোষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার কেন চাপ প্রয়োগ করবে। এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আপনারাই পারেন এ অনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে।”

No comments

Powered by Blogger.