বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৮৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম দুঃসাহসী এক যোদ্ধা
হেমায়েত উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার।
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি থেকে ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিভিন্ন বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজনকে নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করেন। তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করেন।
হেমায়েত প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে এপ্রিলের মাঝামাঝি নিজ এলাকায় যান। একটি ক্যাম্প করেন। তাঁর এলাকা তখনো মুক্ত ছিল। ক্যাম্পে তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। পরে তাঁদের নিয়ে দল গঠন করে নিজ এলাকায় যুদ্ধ করেন। দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি নিজেই। পরবর্তীকালে এ দলের নাম হয় হেমায়েত বাহিনী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এপ্রিলের ২১ তারিখে ফরিদপুর এবং ২৩ তারিখে গোপালগঞ্জ দখল করে। তখন সংগত কারণেই হেমায়েত উদ্দিনের পক্ষে অল্প কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, তাঁর দলের বেশির ভাগই ছিলেন মাত্র এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
তবে হেমায়েত একদম চুপচাপ বসেও থাকেননি। অল্প কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়েই ৪ মে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানায় আক্রমণ চালান। তাঁরা বাঙালি-অবাঙালি পুলিশদের কৌশলে আটক করে থানার সব অস্ত্র হস্তগত করেন। হতবুদ্ধি ওসি ও পুলিশরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনা ওই এলাকার জনগণের মনে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে।
এর পর তিনি আর পিছে ফিরে তাকাননি। সীমিত শক্তি নিয়েই একের পর এক বিভিন্ন স্থানে অভিযান করেন। তাঁর দলের বেশির ভাগ অপারেশনই সফল হয়। কোটালিপাড়া থানায় অপারেশন করার কয়েক দিন পর (৭ মে) পাকিস্তানি সেনাদের বিরাট একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানিরা সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করার ক্ষমতা হেমায়েতের দলের ছিল না। ফলে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য এলাকা ছেড়ে পেছনে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শক্তি সঞ্চয় করেন। ২৯ মে রাতে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে আবার কোটালিপাড়া থানায় আক্রমণ চালান।
তখন থানায় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও অনেক বাঙালি-অবাঙালি পুলিশ ছিল। হেমায়েতের দলের প্রচণ্ড আক্রমণে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশরা পালিয়ে যায়। কয়েক দিন কোটালিপাড়া মুক্ত থাকে। ৩ বা ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারের সাহায্যে আবার কোটালিপাড়া দখল করে।
১৭ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে হেমায়েতের দলের বড় ধরনের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন কোটালিপাড়ার রাজাপুরে ছিল হেমায়েত বাহিনীর ক্যাম্প। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েকটি স্টিলবডি লঞ্চযোগে এসে সেখানে আক্রমণ চালায়। হেমায়েত সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানিরা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।
হেমায়েত উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে সাহসিকতার সঙ্গে আরও কয়েকটি যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে রামশীলের যুদ্ধ অন্যতম। এ যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন। ১৪ জুলাই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হেমায়েত উদ্দিনকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮৪।
হেমায়েত উদ্দিন স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। গুলির ক্ষতে পচন ধরায় তাঁকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। তিন বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার পশ্চিমপাড় গ্রামে। এখন ঢাকায় বাস করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল করিম, মা সখিনা বেগম। দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী হাজেরা খাতুন, মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ হন। দ্বিতীয় স্ত্রী সোনেকা রানী। তাঁদের নয় ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.