নৈতিক অবক্ষয় এবং সন্ত্রাস by এম এ হামিদ খান

কোনো দেশের যুবসমাজ হলো সে দেশের প্রধান শক্তি। তারা জাতির ভবিষ্যৎ ধারক-বাহক। কিন্তু যুবসমাজ যদি পথভ্রষ্ট হয় এবং অসামাজিক ও ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।
আমাদের ছাত্রসমাজ আজ লেখাপড়ার চেয়ে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বেশি ব্যস্ত ও আসক্ত। তাদের অনেকেরই পরিচয় এখন বখাটে ছাত্র হিসেবে। রাস্তাঘাটে এবং মোবাইলে তারা স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করে থাকে। ঘরে-বাইরে- সর্বত্রই নারীরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। পথভ্রষ্ট যুবসমাজের হাত থেকে তাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এখনই।
সম্প্রতি বিশ্বজিৎ নামের এক দরিদ্র পথচারী নির্মমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছাত্র নামধারী কিছুসংখ্যক সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। সন্ত্রাসীদের ছবি, নাটকীয়ভাবে বিশ্বজিৎকে আঘাত করে আনন্দ-উল্লাস করার চিত্র প্রেস মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইন্টারনেটে সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। ধিক্কার জানাচ্ছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগকে। মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য দু-তিনজন মন্ত্রীর, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছে। দেশের একজন নাগরিকের নিরাপত্তা যে সরকার দিতে পারে না, তাদের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই।
বিশ্বজিতের মতো আরো অনেকেই বর্তমান সরকারের নির্যাতনে অতিষ্ঠ। সরকার ছাত্রদের পড়াশোনায় উৎসাহী না করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে সমর্থন করছে।
ছাত্র যার অভিধা, অধ্যয়ন হলো তার তপস্যা। ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে অধ্যয়নের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করাই ছাত্রসমাজের প্রধান কাজ। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। অধ্যয়নের চেয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজ এবং তথাকথিত রাজনীতির প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে আজকের ছাত্রসমাজ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটা হাতিয়ার হয়ে পড়েছে তারা। নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা এবং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ যেখানে ছাত্রদের কাছে কাঙ্ক্ষিত, সেখানে ছাত্রদের কাছে তার বিপরীত তৎপরতাই জাতির কাছে লক্ষণীয়।
পত্রিকার পাতায় আমরা প্রায়শই দেখতে পাই ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের খবর। অনেক মেধাবী ছাত্র অকালে প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিপক্ষ বা নিজ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। এলাকায় বা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার বা শক্তির মহড়া দিতে এসব ছাত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষমতার নেশায় পাগল আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদরা। মদের নেশা ও নারীর নেশা একসময় হয়তো কেটে যায়; কিন্তু ক্ষমতার নেশা ও পদের নেশা কিছুতেই যেন কাটতে চায় না- এতে দেশ ও জনগণের যত ক্ষতিই হোক না কেন। রবীন্দ্রনাথের সংগীতের মতো-
'তোরা যে যা বলিস্ ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।'
আমাদের সোনার মেধাবী ছাত্ররা শুধু রাজনৈতিক সন্ত্রাস নয়, তারা নানা অপকর্মে লিপ্ত। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্রী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে সম্প্রতি। রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্তকরণ, অশালীন ভাষায় প্রেমের প্রস্তাব, মোবাইলের মাধ্যমে বিরক্ত, নগ্ন ছবিসহ মেসেজ প্রেরণ আজ এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ছাত্র নামধারী বখাটে সন্ত্রাসীর কাজ। মেয়েরা কোনো প্রতিবাদ করতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।
কিন্তু এ অবস্থা আর কত দিন চলবে? ছাত্রীদের শিক্ষাজীবনের নিরাপত্তা এবং সব নারীর সর্বাঙ্গীণ নিরাপত্তা নিধানের জন্য সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকদের হতে হবে সচেতন। তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা ও উন্নত চরিত্র গঠনের ওপর জোর দিতে হবে।
পরিশেষে আমাদের প্রত্যাশা, দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্ররা শিক্ষাঙ্গনে নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে। সেই সঙ্গে ছাত্রীরা যাতে ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়ে পড়াশোনা করতে পারে এবং নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে, সে নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
prof.m.hkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.