চরাচর-ট্রেনের হকার by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

'এই চা লাগবে চা, আদা-লেবু দিয়া গরম গরম চা।' 'চানাচুর খান চানাচুর, ঝাল দিয়া লেবু দিয়া চানাচুর।' 'কেক আছে, পানি আছে, কেক খাইলে পানি দিমু।' 'এই ঝালমুড়ি, ঝালমুড়ি আছে ঝালমুড়ি, গরম মসলা দিয়া ঝালমুড়ি।' 'রুমাল আছে রুমাল, রুমাল নেন এক দাম ১০ টাকা।' 'পান সিগারেট পান।'
'বুট আছে, বাদাম আছে, এই বুট লন, বাদাম লন, সময় কাটান।' 'ডিম আছে ডিম, সিদ্ধ ডিম, গরম ডিম।' যারা নিয়মিত ট্রেনে চড়ে তারা এসব ডাকের সঙ্গে অভ্যস্ত। এ ধরনের হাঁকডাকে অনেক সময় বিরক্তির ভাব আসে অনেকের। আবার নিজের প্রয়োজন অনুসারে তাঁদের কাছ থেকেই আমরা কিনে নিই প্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা খাবার।
তাঁরা ট্রেনের হকার। ট্রেনে চড়ার সময় যাঁরা বিভিন্ন প্রয়োজন মেটান যাত্রীদের। আন্তনগর থেকে শুরু করে কমিউটার, মেইল, লোকাল- সব ট্রেনেই থাকে তাঁদের বিচরণ। দিন নেই, রাত নেই কিংবা শীত-গরম নেই- সব সময়ই তাঁদের দেখা মেলে ট্রেনে। আন্তনগর ট্রেনগুলোতে অবশ্য ক্যাটারিং সার্ভিসের মাধ্যমেও বিভিন্ন খাবার বিক্রি করা হয়।
এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে চড়ে হকাররা বিক্রি করেন খাবার কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস। বিক্রির সুবিধার্থে ট্রেনে খুব একটা ভিড় তাঁদের কামনা নয়। হকাররা নির্ধারিত কোনো ট্রেন কিংবা সময় মেনে চলেন না। এক ট্রেনে বিক্রি করছেন তো ক্রসিং বা যাত্রাবিরতির সুযোগে অন্যটায় চলে যাচ্ছেন।
হকারদের বিক্রির কিছু কায়দা দেখলে সত্যিই অবাক লাগে। চলন্ত ট্রেনে কোনো কিছু না ধরে যখন সাধারণ যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকাই দায় তখন মাথায় বোঝা নিয়ে হকারদের দিব্যি হেঁটে চলতে দেখা যায়। পায়ের ওপর 'চয়রা' রেখে চানাচুর বানানোর দৃশ্যটা চোখে লেগে থাকার মতোই। ট্রেনে চড়তে চড়তে হকাররা আরেকটি বিষয় খুব ভালোই রপ্ত করেছেন। সেটা হলো, চলন্ত অবস্থায় ট্রেন থেকে নেমে পড়া। ১০-১৫ কিলোমিটার গতিতেও তাঁরা ট্রেন থেকে নেমে পড়তে পারেন।
হকারদের সঙ্গে আলাপে অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেন তাঁরা। তাঁদের মতে, ট্রেনে ফেরি করা মানে একটা অনিশ্চিত যাত্রা। বাড়ি থেকে সময় ধরে বের হলেও কখন ফিরবেন, কোন স্টেশন পর্যন্ত যাবেন এর বালাই থাকে না। যে কারণে পরিবারকে খুব একটা সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না তাঁদের। এমনও হয় যে সময়মতো রান্নার জন্য কিছু কিনেও দেওয়া হয় না। হকারদের অভিযোগ, ট্রেনে উঠতে 'ভাড়া' হিসেবে দিনকে দিন টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য ওই টাকা সরকারের পকেটে নয়, যাচ্ছে ব্যক্তির পকেটে।
হকারদের বদান্যতায় ট্রেনে চড়তে চড়তে মনেই হবে না যে কোনো কিছুর কমতি আছে কিংবা আমরা কোনো বাজারের বাইরে আছি! কাঁচা মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন আর শাকসবজি ছাড়া কী নিয়ে আসেন না হকাররা। ট্রেনে আপেল, কমলা, পেয়ারা, কলা, আম, জাম, আমড়া, আচার, বিভিন্ন বই, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, চিপস, চকোলেট, চুইংগাম, সমুচা, শিঙাড়া, মিনারেল ওয়াটার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি পাওয়া যায় হকারদের কাছ থেকে।
ট্রেনে চড়ার সময় খেয়াল করলে দেখা যাবে, বিশেষ কিছু এলাকা থেকে সেখানকার প্রসিদ্ধ খাবার নিয়ে ওঠেন হকাররা। যেমন- রাজশাহীতে ট্রেন আসার পরই শোনা যাবে লিচু কেনার আহ্বান। আবার কুমিল্লায় ট্রেন আসার পরই কুমিল্লার রসমালাই কেনার আহ্বান শোনা যাবে। নরসিংদীতে সাগর কলা, শ্রীমঙ্গলে গেলে আনারস, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্যারা মিষ্টি, সিলেটে বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিস ইত্যাদি।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.