সংবিধান সংশোধন-অপশক্তি তো এখনও সক্রিয় by অমিত দাশগুপ্ত

 মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সময় ও সুযোগ দুটিই এখন জাতির সামনে আছে। কিন্তু এ সুযোগ আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, সেটাই প্রশ্ন। কথার বাগাড়ম্বরে কাজ কতটুকু হবে, তা নিয়ে সন্দিহান হচ্ছি
দেশের প্রতি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদ খুব ছোট; কিন্তু সুন্দর করে বলছে, সকল নাগরিকের দায়িত্ব হলো সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা। সর্বোচ্চ আইন সংবিধান মান্য করার কথা বললে সংবিধান কী এবং এতে কী আছে, কী নেই তা সাধারণ মানুষ তো বটে, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরাও জানেন কি-না সন্দেহ। সংবিধান নিয়ে এখন অনেক বেশি কথা হচ্ছে বলেই বিষয়টির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। আইন কী, সেটা না জানলেও আইন মানতে হবে আর আইন ভঙ্গ করলে আইন কাউকে ছাড়বে না, এটাই আইনের বিধান। সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ আইন বই পড়ে জানা-বোঝার দরকার নেই। সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করেই সেটা জানা-বোঝা যায়। পেশাগত বা অন্য প্রয়োজনে যে কেউ যে কোনো আইন পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু সংবিধান সাধারণ আইনের চেয়ে আলাদা। দেশের সর্বোচ্চ আইন। জনগণের পরম অভিব্যক্তিরূপে রচিত ও প্রণীত। কিন্তু জনগণের অভিব্যক্তিটা কী, সেটা বোধহয় জনগণ জানে না। আর এর সুযোগ নিয়ে বারবার সংবিধান কাটা-ছেঁড়া করেছে একদল রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্ত। নিজেদের ক্ষমতা গ্রহণ বৈধ ও একে পাকাপোক্ত করতে সংবিধানে এনেছে নানা পরিবর্তন। দুটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের অনাহূত অংশগুলো শনাক্ত করে বাতিল করেছে। অবশ্য সবটুকু বাতিল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সময় ও সুযোগ দুটিই এখন জাতির সামনে আছে। কিন্তু এ সুযোগ আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, সেটাই প্রশ্ন। কথার বাগাড়ম্বরে কাজ কতটুকু হবে, তা নিয়ে সন্দিহান হচ্ছি। তা ছাড়া পুরনো দুর্বৃত্তরা এখনও সক্রিয়। নিশ্চিত বাধা আসবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাই কাজটা দ্রুত করা দরকার। কারণ এর পর জনগণকে সংবিধানটা বোঝার সময় দিতে হবে। আর তার জন্য সংবিধানের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই জনগণ সংবিধান মান্য করবে এবং দুর্বৃত্তরাও সাহস পাবে না সংবিধানে হাত দিতে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম। ভারত হয়েছে একদিন পরে। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর অতিক্রান্ত হলেও পাকিস্তান নিজের জন্য উপযুক্ত সংবিধান গ্রহণ করতে পারেনি। এর মাশুল তাকে আজও দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে দু'বছরের মধ্যেই নিজেদের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করে তা ধরে রেখেছে ভারত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তারা তাই নিশ্চিত ভালো আছে। স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় আমরাও আমাদের জীবনবিধান রচনা করেছিলাম; কিন্তু ঘাড়ের ওপর পূর্বসূরির ভূত থাকায় সংবিধান ধরে রাখতে পারিনি। কাটাকাটি হয়েছে। তবুও যা ছিল তার জন্যই বোধহয় আমরা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো আছি। আরও ভালো থাকতে চাই, তাই সংবিধানটা চাই জনগণের অভিব্যক্তি হিসেবে। একদল হয়তো বলবে, জনগণ চেয়েছিল বলেই সংবিধানে পরিবর্তন করা হয়েছিল। বিশ্বাস করি না। কারণ তারা জনগণের মধ্য থেকে আসেননি। ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করে জনগণের মধ্যে তা প্রচার করেছেন। আর একদল লোক তাদের দেখানো পথে হেঁটেছে সুযোগ-সুবিধার লোভে। সঙ্গে ছিল ধর্মের সুড়সুড়ি। ফলে কাজটা তাদের পক্ষে সহজ হয়েছে। এখন কাজ অনেক কঠিন। মূল সংবিধানে ফিরে গিয়ে জনগণকে বোঝাতে না পারলে আবার তা ধরে রাখা কঠিন হবে। আমাদের হাতে সময় খুব একটা বেশি নেই।

অমিত দাশগুপ্ত : অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
 

No comments

Powered by Blogger.