কালের আয়নায়-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্পর্কে বিলম্বিত বোধোদয় by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

এক সময় যে বিএনপি ও খালেদা জিয়া ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ঘোরবিরোধী, এখন তারা এই ব্যবস্থার ঘোর সমর্থক ও কাস্টোডিয়ান সেজেছেন।
জোর গলায় বলছেন,
এই ব্যবস্থার কোনো
বিকল্প নেই


জীবনে অনেক রঙ্গই দেখলাম। বেঁচে থাকলে আরও কত রঙ্গ দেখব কে জানে? একমাত্র বঙ্গদেশে জন্ম নিলেই এই রঙ্গ দেখা যায়। কবি বলেছেন, 'এতো ভঙ্গ বঙ্গ দেশে, তবু রঙ্গে ভরা।' এখন বঙ্গদেশে রঙ্গ চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা নিয়ে। ব্যবস্থাটি অবশ্য জন্ম থেকেই বিতর্কিত এবং নানা ক্ষৌরকার্যের শিকার। এখনও ব্যবস্থাটি সাবালক ও স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবু মন্দের ভালো, পঙ্গু ব্যবস্থার ওপর ভর দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রাক্ষসপুরিতে বন্দি ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো বেঁচে আছে।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে দেশের উপনির্বাচনগুলো নিয়ে যে চালিয়াতির খেলা শুরু করেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত জালিয়াতির চূড়ান্ত খেলায় পরিণত হয়েছিল মাগুরার একটি সংসদীয় উপনির্বাচনে। তখন প্রথম একটি অদলীয় এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তিন মাসের জন্য ক্ষমতায় বসিয়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ওঠে। এ দাবি তুলে বিএনপি ক্ষমতায় বসে তারস্বরে এই দাবির বিরোধিতা করেছে। খালেদা জিয়া হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, 'আমরা এ দাবি মানি না। পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হয় না।'
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে হয়। পাগল ও শিশু ছাড়াও যে নিরপেক্ষ লোক পাওয়া যায় তা স্বীকার করতে হয়। 'জনতার মঞ্চের' তাড়ায় ক্ষমতা ছাড়ার আগে মধ্যরাতে সংসদের অধিবেশনে বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া একটি পঙ্গু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তারা জন্ম দিয়ে যান। যে ব্যবস্থার পঙ্গুত্বের সুযোগে তারা আবার সামনের অথবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন এটাই ছিল লক্ষ্য।
ব্যবস্থাটি পঙ্গু হোক; নামটা তো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার প্রধান হিসেবে নিরপেক্ষ এক ব্যক্তি দরকার। পতিত এরশাদ সরকারের শবযাত্রায় পৌরোহিত্য করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। তিনি এরশাদ-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষ প্রধান হিসেবে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। সুতরাং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোতে প্রধান বিচারপতি পদকে নিরপেক্ষ ধরে নিয়ে তাদের প্রধান উপদেষ্টা করার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই দেখা গেল, ষড়যন্ত্রের পঙ্গু ঘোড়াও গিরি লঙ্ঘন করতে পারে।
আগেই বলেছি, বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে (১৯৯৬) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে সংসদে এই ব্যবস্থা মধ্যরাতে একক গোপন অধিবেশনে সংবিধানে সংযোজন করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রের এক পঙ্গু শিশুর জন্ম দেয় এবং তা ধরা পড়ে কিছুদিনের মধ্যে। কথা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি সরকারের মতো সব মন্ত্রী দফতর (দেশরক্ষাসহ) থাকবে এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন উপদেষ্টার হাতে। কিন্তু সংসদের মধ্যরাতের একক অধিবেশনে বিএনপি চালাকি করে সকলের অগোচরে দেশরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে রেখে দেয়। তখন রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন খালেদা জিয়ার আরেক ক্রীড়নক রাজাকার রাষ্ট্রপতি নামে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাস। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। আসল ক্ষমতা প্রধান উপদেষ্টার হাতে। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকার কুমতলবে দেশরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব তাদের পোষা রাষ্ট্রপতির হাতে রেখে দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে ত্রুটিহীন করার ব্যাপারে প্রথম খালেদা সরকার সৎ এবং আন্তরিক হলে সংসদের ভেতরে ও বাইরের বিরোধী দলগুলোকে আলোচনায় ডেকে সকলের পরামর্শ নিয়ে ব্যবস্থাটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নিত। তা না করে তারা সকলের অগোচরে নিজেদের পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করেছেন। তাদের কুমতলব বেশিদিন ঢাকা থাকেনি। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের চরম অদূরদর্শিতা ছিল ওই ষড়যন্ত্রের রাতের সংসদীয় অধিবেশনে যোগ না দেওয়া। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত সংসদ বর্জন অব্যাহত রাখবেন এই গোঁ ধরে বসে থাকায় তৎকালীন বিএনপি সরকার চমৎকার সুযোগ পেয়েছিল ব্যবস্থাটিকে পঙ্গু করে আইনে পরিণত করার। ওটাই ছিল ওই সংসদের শেষ অধিবেশন।
মজার ব্যাপার এই যে, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএনপির নেতা ও মন্ত্রীরা গণরোষের শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ ঘরের বাইরে বেরোতে পারেন না, সংসদের অধিবেশন ডেকে তাতে যোগ দেওয়া দূরের কথা। সংসদ অধিবেশন ডেকে তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আইন পাস করার জন্য নিরাপদে যেতে আওয়ামী লীগের কাছে অনুমতি চাইতে হয়েছিল তাদের। বিএনপি সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে এই আনন্দে আওয়ামী লীগ নেতারা এতই মত্ত ছিলেন যে, তারা নিজেরা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ফলে রাতের অন্ধকারে ধূর্ত বিড়াল যে দুধ খেয়ে গেছে, তা দেরিতে বিড়ালের গোঁফ না দেখা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বুঝতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে প্রথম যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তার প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একজন প্রাজ্ঞ আইনবিদ এবং প্রশংসিত বিচারপতি। তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হলে তিনি দু'দিন সময় চেয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত আইনটি ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার জন্য। বিস্ময়ের কথা, দু'দিন ধরে এই আইনটি পর্যালোচনা করেও তার চোখে পড়েনি যে, এই আইনটি খুবই একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র রেখে অত্যন্ত অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে পাস করিয়েছে খালেদা জিয়ার তৎকালীন সরকার। এই ক্ষুদ্র ছিদ্রটি থাকার ফলে এ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আসল উদ্দেশ্য অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ভার রাষ্ট্রপতির হাতে থাকায় নিরপেক্ষ ও অদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাওয়ার পুরো আশঙ্কা রয়েছে (এই আশঙ্কা পরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে)।
প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বিএনপির ষড়যন্ত্রের মুখোশটি খুলে যায়। দলীয় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সেনাবাহিনীতে বিরোধ সৃষ্টি করে এবং দেশে সামরিক ক্যু ও পাল্টা ক্যু ঘটিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই ব্যর্থ করে দিয়ে বিএনপি পেছনের দরজা দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে যে টেলি ও বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটির প্রচার বিলম্বিত ও পরে কর্তিতভাবে করেছিল টেলিভিশনের সংবাদকক্ষের এক কর্তাই। পরে জানা গেল, তিনি বিএনপির খাস লোক। তাকে তার পদ থেকে বদলি করা হয় এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পূর্ণ অংশ পুনঃপ্রচারিত হয়।
একথা সত্য, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে দেশের সেই চরম সংকটময় মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান যথেষ্ট ধৈর্য, নিরপেক্ষতা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু একজন বিজ্ঞ আইনবিদ হয়েও তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনের ক্ষুদ্র ছিদ্রটি ধরতে পারেননি। যে ছিদ্রটি হলো রাষ্ট্রপতির হাতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব রাখা। এই ছিদ্রের সাহায্যেই দু'দু'বার বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ব্যর্থ এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেছে। একবার রাজাকার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের দ্বারা, অন্যবার বশংবদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনের দ্বারা।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছে সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে লিখছি, তিনি যদি বিএনপি মধ্যরাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করাতে গিয়ে যে ক্ষুদ্র ছিদ্রটি সকলের অগোচরে তৈরি করে রেখে গেছেন, তার অশুভ উদ্দেশ্যটি ঠিক সময়ে ধরতে পারতেন, তাহলে ক্ষমতা গ্রহণের আগেই শর্ত দিতেন, নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব রাখার ব্যবস্থাটি রদ করতে হবে। নইলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত হবে না। সুতরাং তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে না। শাদির প্রথম রাতেই বিড়াল না মারায় পরবর্র্তীকালে এই বিড়াল কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল তা আমরা ওয়ান-ইলেভেনের আগে এবং ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও দেখেছি।
বিস্ময়ের কথা, ১৯৯৬ সালে বিদায়ী বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাসের সময় যে ছিদ্রটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে রেখে গেছে, তার গুরুত্ব সময়মতো বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগও। তারা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার এই ত্রুটিটি সংশোধন করার জন্য সামান্য উদ্যোগও গ্রহণ করেনি বা এ সম্পর্কে তেমন আলোচনার সূত্রপাতও করেনি। ফলে আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি হয়েও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তথাকথিত সুশীল সমাজ, দুটি তথাকথিত নিরপেক্ষ পত্রিকা এবং একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতার প্রভাব এবং পরামর্শ দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পরামর্শ উপেক্ষা করে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যা এই রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষতার সুনামকে যথেষ্ট নষ্ট করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে ব্যর্থ অথবা বিকৃত করার জন্য এহেন চাতুরী ও অসাধুতা নেই, যা বিএনপি করেনি। প্রধান উপদেষ্টা পদে যাতে তাদের আজ্ঞাবাহী কোনো বিচারপতিকে বসানো যায়, সে জন্য লোকলজ্জার কোনো ধরনের তোয়াক্কা না করে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স নিয়ে ধূর্ত খেলা শুরু হয় (কেউ কেউ বলেন, এ জন্য ড. ইউনূসের পর ব্যারিস্টার মওদুদকেই একটা নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত)।
ওয়ান-ইলেভেনের আগে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব হাতে থাকায় বিএনপির বশংবদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃত্ব নস্যাৎ করে এককভাবে (নেপথ্যে খালেদা-তারেক) শাসন চালাতে শুরু করেন। অবৈধভাবে নিজেকে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বসিয়ে সামরিক প্রধানদের বৈঠক ডেকে বললেন, তার সরকার এখন প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার। একথাটা বলার আগে তিনি একবারও ভেবে দেখেননি, তাকে সংবিধান কর্তৃক নির্দিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চরিত্র বদলের অধিকার কে দিয়েছে? বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদে নতুন নতুন মুখ এনে, দলীয় প্রধানের টেলিফোন নির্দেশে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি গোটা দেশ ও জাতিকে এক মহাসর্বনামের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। তার সরকারের নেতৃত্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তো হতোই না, দেশে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
যথাসময়ে ওয়ান-ইলেভেন এসে দেশকে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বিএনপি-সৃষ্ট ছিদ্রপথ ধরেই ওই ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এটাকে সেনা পরিচালিত অনির্বাচিত সরকারে পরিণত করা হয় এবং তিন মাসের জায়গায় বেআইনিভাবে দু'বছরের বেশি ক্ষমতায় রাখা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কাজ সেটা ঝুলিয়ে রেখে এই সরকার তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত এমন সব কাজ করতে থাকে যা দেশে দুর্নীতি ও লুটপাট বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ফলে বিলম্বে হলেও দেশের সচেতন মহলগুলোর এখন বোধোদয় হয়েছে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তারা চেয়েছিলেন, তা তারা পাননি এবং যেটা তারা পেয়েছেন, তাকে দু'দু'বারের টার্মেই এতটা ব্যর্থ ও বিকৃত করে তোলা হয়েছে যে, এর আশু সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন। নইলে এই ব্যবস্থাটি বলবৎ রাখার কোনো দরকার হয় না। বিএনপি মুখে বলছে, তারাও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সংশোধন চান। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগে তারা কোনো ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছেন না। সরকার অবশ্য এ পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। যেমন গত বুধবার (২৭ এপ্রিল) সংসদ ভবনে এই সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতিপয় প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাবগুলোও বিতর্কমুক্ত নয়। সুতরাং এ প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা চলছে।
এই নিবন্ধটির সূচনাতেই বলেছি, জীবনে অনেক রঙ্গরস দেখেছি। এখনও দেখছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্পর্কে অতীত ও বর্তমানের বিতর্কও কি রঙ্গরসভর্তি নয়? এক সময় যে বিএনপি ও খালেদা জিয়া ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ঘোরবিরোধী, এখন তারা এই ব্যবস্থার ঘোর সমর্থক ও কাস্টোডিয়ান সেজেছেন। জোর গলায় বলছেন, এই ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। যদি তাই হবে তাহলে এই ব্যবস্থায় তারা যেসব ক্ষতিকর ছিদ্র তৈরি রেখে গেছেন, সংশোধনী প্রস্তাব এনে সেই ছিদ্রমুখগুলো বন্ধ করার জন্য নিজেরাই এখন এগিয়ে আসছেন না কেন?
লন্ডন, ২৯ এপ্রিল, শুক্রবার, ২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.