সূর্য ওঠার আগে by রাবেয়া খাতুন

বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, গাছের ডাল আর ছোট্ট মফস্বল শহরটিতে যে কটা পাকা দালান আছে সেগুলোর দেয়াল পোস্টারে পোস্টারে সয়লাব। লাল নীল সবুজ ঝকঝকে যত রং আছে সব গুলিয়ে যেন লেখা হয়েছে একটি নাম_জনদরদী চুনি মিয়া। এই এলাকায় তাঁর প্রথম আগমন। এসেছেন রোগাভোগা হতাশ মানুষকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিতে, উৎসাহ জোগাতে।


ওমা শুনছ, তিনি আসবেন মেয়েদের হাই স্কুলের মাঠে বক্তৃতা দিতে। সোমা সালেহারা সবাই যাবে। আমাকেও কিন্তু নিয়ে যেতে হবে।
সখিনা শিমের বিচি বুনছিল। কোনও সাড়া-শব্দ করছে না দেখে মিতা আবার বল্লো, কি হলো তোমার? এমন একজন লোক আসছেন যার নামের আগে জনদরদী_
সখিনা কথা শেষ হতে না দিয়ে ঘাড় ফেরাল_কারা দিয়েছে?
ক্যানো, দেশের লোক। তিনি যে আবার নেতাও।
ক্যানো এসেছে?
দুঃখী মানুষকে আশা দিতে। ভরসা দিতে।
থাম। আসলে এসেছে তো ভোট চাইতে।
অ, তুমি বুঝি এই সকালেই 'আলোর মিছিল' পড়ে ফেলেছ। ওটা হচ্ছে চিরকেলে বামপন্থী পত্রিকা। ভালো ইমেজকে ড্যামেজ করতে ওদের জুড়ি নেই। কাগজটা সামনের মাস থেকে বদলে ফেলি এসো। অত কম দামে অমন ভালো দৈনিক এখান থেকে আর কি একটিও বের হয়?
আচ্ছা, সে না হয় মানা গেল। আমায় নিয়ে মাঠে যাবে কি না বল।
দেখি।
দেখি নয়। যেতেই হবে। নইলে আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে ভাবনাচিন্তায় পিছিয়ে যাব। আধুনিক থাকবো না। তোরা কি এখনো আধুনিক আছিস?
নই?
থাকলে কে শত্রু, কে মিত্র বুঝতে পারিস না ক্যানো? যুগটা চরম স্বার্থসচেতন। সংখ্যায় দিন দিন এরা বাড়ছে। তাই চোখ থেকে চলে যাচ্ছে আসল চেহারা দেখার ক্ষমতা।
তুমি যে মাঝে মাঝে কী সব বল, মাথামুণ্ডু বুঝি না।
বুঝবি। খাঁড়া যখন ঘাড়ে এসে সরাসরি পড়বে তখন দিব্যদৃষ্টি লাভ করবি। যা এখনই হওয়া দরকার ছিল। বয়েস তো কম হলো না।
আসলে কত?
আদুরে ভঙ্গিতে সখিনার পিঠ ঘেঁষে বসে মিতা তখনি বল্লো, স্কুলের খাতায় যা-ই লেখা থাক, আসলে কত?
এই ডিসেম্বরে পুনেরো শেষ হয়ে যাবে।
কি মজা! সুইট সিঙ্টিনে পড়ব। এই উপলক্ষে আমাকে কিন্তু ঢাকা থেকে লেটেস্ট ফ্যাশনেবল ড্রেস উপহার আনিয়ে দিতে হবে। পিয়াল ভাই এ মাসেই ঢাকা যাবে, তার কাছে টাকা দিয়ে দেবে। দেবে তো?
মিতা সখিনাকে দুহাতে জড়িয়ে ঝাঁকানি দিলে সখিনা তাকাল ঠাণ্ডা চোখে। মিতা ভয় পেল। ঐ দৃষ্টি কালেভদ্রে চোখে চমকালেও তার জানা হয়ে গেছে মানেটা। ভাবনার ভিতর মা এখন ঢুকে আছে কোনও শক্ত বিষয়ে। কী ব্যাপার! পরের ডায়ালগটা দিতে গিয়ে কেমন দুর্বল হয়ে গিয়ে বল্লো_কী, বলবে না কিছু!
চোখ পাথরের মতো। কিন্তু কণ্ঠস্বর অসদয় নয় সখিনার। বল্লো, পিয়াল কবে যাবে ঢাকায়? সঠিক তারিখটা আমি জেনে আসছি।
গলার কাছে মাফলারের মতো ফেলে রাখা ওড়না ছড়িয়ে গুছিয়ে মিতা ছুটল পিয়ালদের বাড়ির দিকে। বীজ বোনা রেখে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে দূরমনা হয়ে গেল সখিনা। যেন নিজেকেই শুধাল, কত বয়স মিতার? পনেরো। পনেরো... এটাও মিষ্টি বয়স। কবে তার জীবনে এসেছিল বুঝতেও পারেনি। পাড়াগাঁয়ের মায়েরা না ঠিক বলতে পারে নিজের বয়স, না গর্ভজাত কন্যার। তবে সে যে পুরুষের কাঙ্ক্ষিত নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে বুঝতে পারত সাকিবের খোলা খোলা চোখের চাউনিতে। দেশগাঁয়ে এমনিতেই এশার নামাজের পর ঘরে ঘরে বাতি নেভে। সে বছরটা যেন এল জুজুর ভয় নিয়ে। নদীর এপার ওপার নয়াভাঙ্গা, নবীপুর, তারপর মফস্বল শহর। সেখানে ক্যাম্প পড়েছে পাকিস্তানি আর্মির। যে কোনও সময় গোলাবারুদ নিয়ে ওরা চলে আসতে পারে গ্রামের দিকে। গ্রামকে রক্ষা করছে সন্ধ্যা নদী। পানিকে ভীষণ ভয় পাঞ্জাবীদের। নদনদী খালবিল যা-ই হোক, ওদের জবানিতে দরিয়া। সাঁতার না জানা ওদের কাছে দরিয়ার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু নেই। গ্রামের লোক বলে, নদী তো নয়, আমাদের রক্ষা-কবজ।
কবজের ওপরও নাকি জাদুবিদ্যা চলে। শোনা যেতে লাগল বাঙালী গাদ্দারটা ভাঙ্গা বেড়ায় খোঁজ দিচ্ছে চতুর ধূর্ত শেয়ালদের।
মসজিদে আম মজলিস বসে। মাতব্বর চাচা সবাইকে সাবধান করেন, অ্যামনিতেও কেরাসিন ত্যালের আকাল, তোমরা মিয়ারা রেলির ত্যালের পিদিম দিয়া কাজ চালাইও। আর পরথম রাইতে ঘোমায়া শ্যাষ রাইতে সজাগ থাকনের চ্যাষ্টা কইরো।
সে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সাকিবের সে কী চাপা খুশি! বল্লো, বুঝলে সখি, একেই বলে শাপে বর।
সখিনা দরোজা বন্ধ করতে করতে শুধায়, যেমুন?
আহা কত আর বলব, যেমুন নয়_যেমন। আজ না হয় দেশে যুদ্ধ লেগেছে, আমি চাকরি থেকে, শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি। চিরকাল কি এমনি থাকবে? যুদ্ধ শেষ হবে, আমি কাজে ফিরে যাব। আমার সঙ্গে তুমিও। তখন এইসব পাড়াগেঁয়ে ভাবভাষা ছাড়তে হবে। প্র্যাকটিস কর। বল যেমন।
আচ্ছা, বল্লাম যেমন। কিন্তু শাপে বর হলো কী করে?
এই যে সন্ধে হতে না হতে তুমি শোবার ঘরে ঢুকতে পার। দিনেমানে ক'বারই বা তোমার সঙ্গে দেখা হয়? তখন তো তুমি মা-বাবা, আমার যাবতীয় আত্মীয়স্বজনের। আমি বেচারার জন্য রাতটাই সম্বল। রাত নয়, যেন বরফের টুকরা। দেখতে না দেখতে গলে পানি।
এ সময় সাকিবের চোখে চমকায় যে দৃষ্টি তা থেকে সখিনা বুঝতে পারে নিজের নব মূল্যায়ন। বিয়ে হয়েছিল তো দু'বছর আগে।
গত বছরও তার শরীর ছিল কাঠ কাঠ। ছুটিতে বাড়ি এলে দেখাসাক্ষাৎ যাও বা হতো খুব একটা পাত্তা পেত না স্বামীর কাছে। গরজ করে কেবল জিজ্ঞেস করত, স্কুলে ঠিকমতো যাচ্ছ ত?
বাধ্য ভঙ্গিতে সখিনা ঘাড় দোলাত। সাকিব গ্রাম থেকে স্কুল পাস করে শহরের সওদাগরী অফিসের জুনিয়র ক্লার্ক। পাক সেনারা সে অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। হাতের কাছে যাদের পেয়েছে সোজা নিয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। ঐ এলাকা আর আজরাইলের আখড়ায় তফাৎ ছিল না কিছু। সাকিব গ্রামে পালিয়ে বেঁচেছিল। ঠিক করেছিল সীমান্ত পার হয়ে যুদ্ধে চলে যাবে। গ্রাম ছেড়ে কত ছেলেই চলে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু সিনার জোর দুর্বল হয়ে গেল সখিনার সঙ্গে দেখা হয়ে। বৌ তার সুস্থ সবল সুন্দরী তরুণী। কথাবার্তা, চালচলন, বেশভূষায় রীতিমতো আকর্ষক। সবচেয়ে মারাত্মক চোখ। কী মোহমায়াময়। ওকে ছাড়া যুদ্ধের ময়দান কি চিন্তা করা যায়? যে রাতে জমকালো কৃষ্ণপক্ষের পর ক্ষয়া চাঁদ উঠত, লুকিয়ে নদীর ধারে আসত। সখিনা বলতো, তুমি না যুদ্ধে যাবে বলেছিলে? সাকিব বৌকে ঘাড়ে পিঠে আদর করতে করতে জবাব দিতো, যাব। তবে একলা নয়।
এমা, মেয়েরা কি যুদ্ধে যায়? উম্।
মেলা মেয়ে গেছে, যাচ্ছে।
তারা রাইফেল দিয়ে লড়াই করছে?
যুদ্ধে কি খালি অস্ত্র লাগে? মেয়েরা অস্ত্রের ট্রেনিং কোথাও কোথাও নিচ্ছে শুনেছি। তবে আহত মুক্তিসেনাদের যারা সেবা যত্ন দিয়ে নতুন জীবন দিচ্ছে তাদের তুলনা নেই। ভালো হবে না যুদ্ধে একসঙ্গে গেলে?
কিন্তু তোমার বাড়ি আমার বাড়ি কেউ কি যেতে দেবে?
আরে আমরা কি বলেকয়ে যাব নাকি? এই যে তোমার মিয়া ভাই মাহমুদ গেছে। বলেকয়ে কি গেছে? যায় না কেউ।
আদরের মাত্রাটা আর একটু চড়া করে তখনি বলে, আসলে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তাইতো আর সখিনা ডাকি না। সখি ডাকি। সেই সঙ্গে মনে পড়ে আমার নাম ক্যানো কাশেম হলো না। ইমাম হাসানের ছেলে কাশেম। ইমাম হোসেনের মেয়ে সখিনা। পড়েছ না তাদের মিলন আর বিচ্ছেদের কথা?
পড়েছি। রসুল দাদার পুঁথিতেও কত শুনেছি। চোখভি-মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। দূরে বিদ্যুৎ নয় চমকাল আগ্নেয়াস্ত্রের আলো। লাল সবুজ হলুদ। ছুটন্ত তারার মতো বিচ্ছুরিত। আতঙ্কে সাকিবকে আঁকড়ে ধরল সখিনা। সাকিব অভয় দিয়ে বল্লো, ওগুলো বহু দূরের।
তারপর আবার ফিরে গেল আগের ঘোর লাগা কণ্ঠস্বরে, এখন আমাদেরও চারদিক ঘিরে রেখেছে জালিম এজিদের সৈন্যরা। বাংলা হয়েছে কারবালার ময়দান। তফাৎ শুধু কাশেম নবপরিণীতা বৌ-এর কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে লড়াইয়ের মাঠে শহীদ হয়েছিলেন। আমি যুদ্ধে যাব সখিনাকে সঙ্গে করে। খুব ভালো হবে।আমিও তোমায় ছেড়ে একা আর থাকতে পারবো না গো।
নিশুতি রাতে অগুন্তি নক্ষত্রমালার তলায় প্রিয় এক পুরুষের রোমশ বুকে ঠোঁট ঘষা নারীর উচ্চারিত কথায় অদৃশ্যে কারা হেসেছিল কে জানে। যে আগুনের ঝলকানিকে মনে করা হয়েছিল দূরের, কাছে কাছে আসতে খুব একটা সময় নিলো না। যন্ত্রের ছোট ছোট নৌকা থেকে খাকি পোশাক পরা কারা নামলো, সঙ্গে বেঢপ পোশাকের বিভিন্ন বয়সের কিছু বাঙালী। প্রচুর না হলেও বন্দুকের গোলাগুলি কিছু হলো। গেরস্তের ঘর, গোলা, গোয়াল লুটপাট, আগুন দেয়া। সূর্য সম্মুখে চাবুকের বাড়ি লাগাতে লাগাতে মাতব্বর চাচাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে বোটে তোলা হলো। কয়েকজন যুবককেও। ঝি বৌরাও নাকি কিছু গায়েব হয়েছে।
চারচালা ঘরের কাঠের 'কারে' উঠে বাঁশের সিঁড়ি লুকিয়ে ফেলছিল সাকিব। ওপর থেকে জালিতে দৃষ্টি রেখে দেখেছিল, ওরা এ বাড়ির আঙ্গিনা অব্ধি এসে ফিরে গেল। চারদিকে যখন আহতের আর্তনাদ, বারুদের গন্ধ, পাখিদের নীড় ছেড়ে উড়ে যাওয়া, কুকুরদের অনর্গল চিৎকার, তখন এ বাড়িটা একদম নিরাপদ। অলৌকিক ঘটনা যেন। পরদিন আন্দাজ করা গেল সবই জাগতিক।
দুপুরের দিকে লম্বা চওড়া এক যুবক এসে ডেকে নিয়ে গেল সাকিবকে। সারা বাড়িতে পড়ে গেল আহাজারি। হাই স্কুলের মাঠে আস্তানা নিয়েছে দুজন আর্মির সঙ্গে দেশী আলবদর। শোনা গেছে, আলবদর, আলশামস, রাজাকার_এরা জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও কাজকামে ওদের চেয়ে কম নিষ্ঠুর নয়। এদের হাতে না জানি কত নাস্তানাবুদ হচ্ছে সাকিব।
এ বাড়িতে সারা দিন চুলায় আগুন জ্বললো না। বাচ্চারা ক্ষুধায় খ্যান খ্যান করতে করতে ঘুমিয়ে গেল এখানে ওখানে। সখিনা জায়নামাজ থেকে উঠলো না এক পলক।
একদিন দু'দিনেও ফিরলো না সাকিব। খবর রটল, ওকে ঝুলিয়ে রেখেছে ক্যাম্পের ধারের বিশাল আমলকী গাছের ডালে। কেউ বল্লো, নিজের চোখে দেখেছি ওর ক্ষত-বিক্ষত লাশ সন্ধ্যা নদীর স্রোতে ভেসে যেতে।
বাড়িতে মাতম উঠল। সখিনা ঘোষণা দিল, না খেয়ে শুটকি হয়ে সেও শামিল হবে শহীদ স্বামীর সহমরণে। দুরাত দুদিন যেতেও কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেলো না। জব্বর জেদী মেয়ে। এখন বলছে বিনা আহারে মারা যাবে। তখন হয়তো গলায় ফাঁস দিয়ে একদমে বিদায় নেবে।
তৃতীয় দিনের রাতের অন্ধকারে মাহমুদ এলো শুকনো মুখে। বোনের জায়নামাজের পাশে বসে বল্লো, সখিনা, বিনা কাজে উপোস থেকে আত্মাকে কষ্ট দিসনে। যা, খেয়েদেয়ে ভালো থাক। সাকিব আজ কিংবা কাল ফিরে আসবে।
মিয়া ভাই, ঠিক কথা, হক কথা বলছ তো?
একেবারে খাঁটি কথা। দুশমনরা ওকে ছেড়ে দেবে।
সে ফিরে আসছে। ওহ মিয়া ভাই, এ যে আসমানী খবরের মতো লাগছে।
পরক্ষণে মাহমুদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, এ সংবাদ আমাকে যেমন সুখী করছে, তোমার বেলা তা নয় ক্যানো মিয়া ভাই! তবে কি সে আধমরা অবস্থায়_বোনের চোখের ওপর ডান হাতের পাঞ্জা নাড়িয়ে দ্রুত বাধা দিলো মাহমুদ_নারে না, সে সব নয়। এলেই দেখবি। আমি যাই।
তড়িঘড়ি জায়নামাজ গুটিয়ে সখিনা বল্লো, কে জানে কোত্থেকে এসেছ। একটু তো মিসরির শরবত খেয়ে যাও মিয়া ভাই!
নারে, সন্ধ্যা নদীর দুপারেই শান্তি কমিটি, আলবদরদের ছায়ার মতো আনাগোনা। শুকুনের মতো চোখ। মুক্তিযোদ্ধাদের জ্যান্ত ধরতে পারলে মেলা ইনাম। টাকা আর ক্ষমতার লোভের কাছে ওরা দেশ, বিবেক, আত্মা সব বিকিয়ে দিয়েছে। ওরা পারে না এমন কোনও নিকৃষ্ট কাজ নেই।
মাহমুদ গায়ের চাদর ঠিক করে কিছু মনে পড়ে যাবার ভঙ্গিতে একটু দাঁড়ালো। ঘরে চিড়া আখের গুড় থাকলে বরং পুঁটলি বেঁধে দে। পঞ্চবটীর যেখানে আস্তানা নিয়েছি, ছেলেরা আধপেটা খেয়ে এ্যামবুশে যাচ্ছে ক'দিন থেকে।
রীতিমতো পৃথুলা একটি পোঁটলা চাদরে ঢাকা দিয়ে বাড়ির পেছনের আঁধার মাহমুদের দীর্ঘ ছায়া একাকার হয়ে যেতে সখিনা লম্বা শ্বাস নিলো_হায়রে, না জানি কদ্দিন ভরপেট খাওয়া নেই মিয়া ভাইয়েরও। তাইতো মুখ অত শুকনো।
পরদিন বেলাবেলি সাকিব ফিরে আসতে সখিনারও মুখ শুকিয়ে এতটুকু। সাকিবকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, গায়ে ছিল গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, খালি পা। সে এসেছে ঢলঢলা খাকি পাকিস্তানি ইউনিফর্ম বুট জুতা মোজা টুপি মাথায়। বারান্দার চৌকিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে। গোটা পরিবার তাকে ঘিরে। হাঁটু নাচাতে নাচাতে সাকিব বল্লো, বুঝলে মা, বাড়িঘর ঝি বৌ গরু-ছাগল নিয়ে আর ভাবনা নেই। উল্টো লোকজন এসে নানা রকম জিনিস দিয়ে যাবে।
রাতে স্বামী ঘরে এলে সখিনা প্রদীপের আলোয় তাকে ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে বল্লো, তুমি, আলবদর হয়েছ?
আলাবদর না, রাজাকার। কেমন রাখা রাজা নাম না?
নাম যা-ই হোক, ওরা তো খান সেনাদের কেনা গোলাম। না না, খুব দোস্তি আমাদের সঙ্গে। একেবারে মাইডিয়ার। এ ক'দিন একসঙ্গে খানাপিনা, এ্যাকশনে যাওয়া।
কেমন এ্যাকশন?
ওরা লিস্ট করে দেয়। আমি তো শিক্ষিত তাই একবারে কমান্ডার র‌্যাংক। দলবল নিয়ে অবাধ্য লোকদের বাড়িঘর পোড়ান ঘাড় ত্যাড়া পোলাপানদের সিজিলমিছিল করার জন্য ক্যাম্পে তুলে নেয়া, আর_
ঢোক গিললো সাকিব। সঙ্গে সঙ্গে কথা বল্লো সখিনা_উম, গলায় আটকাল বুঝি? আর কম বয়সী মেয়েদের ধরে মোছুয়াদের ভেট দেয়া। এই তোমার ক্ষমতার নমুনা?
না না। আমি ওদের পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছি, মেয়েঘটিত ব্যাপার-স্যাপারে একেবারে হেলপ করতে পারবো না।
তুমি না কর, তোমার সহযোগী করবে। ইস, নিজের দেশের লোকদের সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে?
তো কি করবো? ডাকাতের দেশে ডাকাত না হলে পরিবার বাঁচান যায় না।
সাকিব হঠাৎ রেগে গেল। এই তোমার কথাই ধর। অলরেডি কারা খবর করে দিয়েছে এ বাড়িতে সুন্দরী ষোল বছরের বধূ আছে। আমি রাজাকার না হলে এত দিনে ওরা তোমায় ছিঁড়েফেড়ে খেয়ে ফেলত। আর আমাকে_খাকি বদলাতে বদলাতে সাকিব বলতে লাগল, বাঙালি যুবকদের জন্য একটি বুলেট খর্চা করতেও আজকাল ওরা চায় না। যুদ্ধ কবে শেষ হবে কে জানে? যুবকদের জন্য তাই গাছের ডালে ফাঁসি, নয় চাপাতিতে জবাই, যুবতীদের জন্য গ্রুপ ধর্ষণে মৃত্যু। বল, সেই মৃত্যুর চেয়ে আমি যে বেঁচে বর্তে রীতিমতো পজিশন নিয়ে ফিরে এসেছি, সেটা ভালো হয়নি! তুমিও সধবা আছ। বেআবরু হতে হয়নি তোমাকে। আমাকে সমর্থন দিয়ে শক্তি দাও।
তা কেমন করে দেব। তুমি ফেরত এসেছো। আল্লাহর কাছে হাজার বার শুকরানা নামাজ আদায় করব। কিন্তু এ তোমার কেমন ফেরা?
সখিনা স্টিলের আলমারির বন্ধ ডালায় মাথা কোটে_তুমি না কারবালা ময়দানের অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সৈনিক কাশেম হবে বলেছিলে? বিবি সখিনার মহান যোদ্ধা স্বামী কাশেমের নিয়ত ছিল তোমার। সেই তুমি হয়ে এলে রাজাকার!
স্ত্রীকে সামাল দিতে দিতে সাকিব বল্লো, ওগো সখি, আসলে আত্মরক্ষার লেবাস এটা, আসল পোশাক নয়। মনে মনে মুক্তিযোদ্ধা।
কিন্তু আজ করবে তো ওদের বিরুদ্ধেই। কবে শুনব মিয়া ভাইকে তুমিই ধরিয়ে দিয়েছ মিলিটারিদের হাতে।
না না। তেমন নিমকহারামি কাজ কক্ষনো করবো না। দলে আমাদের চুনি ভাই আছে। দেশের জন্য টনটনা ভালোবাসা। বড় ভালো লোক। দাওত করে তাকে একদিন খাওয়াতে হবে। কথা কানে গেছে কি যায়নি সখিনার। দুগাল বেয়ে ঝরছিল পানি। শুকরানা নামাজ পড়তে পড়তে কান্না দ্বিগুণ হয়েছিল। দু'হাত আকাশমুখী করে বারবার বলছিল, খোদা স্বামী ফেরত চেয়েছিলাম। এ তুমি কাকে ফেরত দিলে? ক্যাম্প থেকে সব রাতে নয়, কোনও কোনও রাতে বাড়ি ফিরত সাকিব। প্রতিবারই পরিবারের সবার জন্য নিয়ে আসত সোনা রুপা নতুন কাপড়চোপড়। আর তার দেশী ও ওপরওয়ালা চুনি ভাইয়ের সুনাম। পাক্কা মুসলমান বলতে যা বোঝায় সে তাই। বয়সে যুবক কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, মাসভর রোজা, তার ওপর তাহাজ্জুদ পড়ে। ওর ছবি দেখিয়ে সাকিব গর্বের সঙ্গে বলেছিল, এ বয়সেই দেখ নামাজ পড়ে পড়ে কপালে দাগ ফেলে দিয়েছে। সাচ্চা মুসলমান।
কিন্তু সখিনার চোখ সেই ছবিতে দেখেছে জ্যান্ত শয়তানের মুখ। ও কেমন চাউনি! লালসা পিছল ঠোঁট। সাকিব বলছে, ও তোমার দেখার ভুল।
ভুলটা কার ছিল প্রমাণ হলো নভেম্বরে। ভর দুপুরের রোদে বাড়িতে আগুন জ্বললো। ঘরে বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি। দরজায় শেকল। ওরা পুড়ে মরবে। কারণ ওদের ছেলে সাকিব গাদ্দারি করেছে জাতির সঙ্গে। সেই অপরাধে গোয়ালের সব পশুর সঙ্গে বাঁধাছাদা হয়ে ক্যাম্পে চালান হলো সখিনা। বিবস্ত্র অবস্থায় এনে ফেলা হল চুনির চেমবারে। কাঠের চেয়ারের ওপর বসে একটা ধারালো ছোট্ট ছুরি নিয়ে খেলছে। হেসে বল্লো, এসো এসো।
যারা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছিল তাদের উদ্দেশে আপোসের বকুনি লাগালো, হাজার হোক আমাদের সাকিবের স্ত্রী। ওকে এমন আধা ন্যাংটা করে নিয়ে এসেছিস? যা যা ভালো কাপড় নিয়ে আয়।
মাটি থেকে উঠে বসে দু'হাত জোর করে সখিনা বল্লো, আপনাকে আমার স্বামী খুব ভক্তি করে। প্লিজ আমাকে বাঁচান। আমার স্বামীই বা কোথায়?
তাকে আজই কোতল করা হবে। আমাকে বলতে পার প্রকৃত দোস্ত। ওর শেষ ইচ্ছা তোমাকে দেখার। স্যারদের কাছ থেকে সে হুকুম মঞ্জুর করেছি। নাও তুমি পোশাক পাল্টে নাও।
একসেট ঝকমকে সালোয়ার-কামিজ রেখে কারা দরজা ভিড়িয়ে গেছে। ভয়ে ত্রাসে সখিনার সারা গায়ে কাঁপন। কাঁপা গলায় সে বল্লো, আমি ওসব পোশাক কখনো পরিনি।
এখন পরতে হবে। না পার আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
দোহাই আপনার। আমার সতীত্ব নষ্ট করবেন না।
সর্বনাশ, আমি কি তা করতে পারি? স্যাররা রয়েছেন না, আগে তারা চেখে খেয়ে দেখুন। তারপর তো এ বান্দা।
চুনি সারা পোশাক একটানে ছিঁড়ে বেহায়া হাসি দিয়ে বল্লো, লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবতী যুবতী। পাঞ্জাবীরা এমন শরীরের মেয়েদের খুব পছন্দ করে।
পোশাকের ওপর একটা চেয়ারে বসিয়ে যাকে ডেকে পাঠান হল তার সারা গায়ে চাবুকের দাগ। রক্তাক্ত মুখ। ফোলা ঠোঁটের নোনা রক্ত চেটে নিয়ে সাকিব অতি কষ্টের চেয়েও করুণ হেসে বল্লো, সখি, মাফ করে দিয়ো। ঐ চুনি শালার সব ষড়যন্ত্র। পাঞ্জাবীরা ওর চেয়ে ইদানীং আমায় পছন্দ করছিল। তাই_দমাদম থাপ্পড় পড়ল গালে। চুনির ইঙ্গিতে টেনে নিয়ে যাবার আগে জবাই করা পশু আর্তনাদে সাকিব বলে গেল, আজ আমি যাচ্ছি। শয়তান তুইও রক্ষা পাবি না। গাদ্দারির শাস্তি তুই পাবিই।
সখিনা উঠে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছে চুনির পায়ের কাছে। কাতর কান্নায় বলছে, আমাকে নিয়ে যা খুশি করুন। আমার স্বামীকে বাঁচান।
হাতের তীর ছুটে গেছে, আর কোনও উপায় নেই।
সখিনা উঠে চোখ মুছে বল্লো, আপনি তো এ দেশেরই ছেলে, বিশ্বাসঘাতকদের হাত ধরে কদ্দিন বাঁচতে পারবেন?
ও, তুই তো আবার মুক্তিযোদ্ধার বোন। তবু বলি, মুখ সামলে দিয়ে জবান খুলিস। যদ্দিন হায়াত আছে বাঁচব। স্যারদের মন রাখা বিদ্যা রপ্ত করে ফেলেছি। মারে কার সাধ্য! আর ধরে নাও যুদ্ধে জয় আমাদের মানে পাকিস্তানিদের হয়েই গেছে। আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে। চীনারা তো শুরু থেকেই গোলাবারুদ রাইফেল দিচ্ছে। দু'দুটো বৃহৎ শক্তি যাদের ফরে ভারতের দরদ যতই উথলে পড়ুক, শেষ পর্যন্ত কিস্যু হবে না। পাকিস্তান পাকিস্তানই থাকবে। আর আমার মতো সাচ্চা সেবাদাসরা বছরে বছরে উন্নতির শিখরে উঠবে। তখন তুমি বিবি সখিনা আমার ঘরের দাসী বাদী হতে চাইবে।
এক মুখ অট্টহাসি দিয়ে পরক্ষণে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়াল। কে আছিস, এই মালটাকে এক নম্বর স্যারের ঘরে দিয়ে আয়।
পাঞ্জাবী পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ঘরে কয়েকটা রাত কাটল ওদের গ্রুপ ধর্ষণের নারকীয় উৎসবে। হঠাৎ কী হলো। ক্যাম্প উঠে গেল। শুরু হলো পালান। অতর্কিতে মুক্তিদের আক্রমণে সব তছনছ। ক্যাপ্টেন ধরা পড়েছে। আরও কতজন। বীভৎস অত্যাচারে জর্জরিত সখিনার জ্ঞান এমনিতেই ছিল না। চোখ মেলে দেখল বাইরে প্রচুর সকালের আলো। সে শুয়ে আছে। প্রথম মনে হলো কবর। নয়তো দু'দিকে দেয়াল ক্যানো? কিন্তু আকাশ দেখা যাচ্ছে। হাল্কা মেঘ ভাসা নীল আকাশ। কবর থেকে কি তা দেখা যায়? তবে কি দেশ স্বাধীন হয়েছে? মুক্তিভাইরা রক্ষা করেছে তাদের লাঞ্ছিতা দুঃখিনী বোনদের! আঃ চিন্তা তো নয়, মধুর স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্ন যদি সত্যি, এখানে শুয়ে ক্যানো?
মাথার দিকে শুকনো খাবারের একটা ঠোঙ্গা পড়ল এ সময়, একজোড়া পাও থেমে এল। রাজাকার কমান্ডার চুনি। অহংকারী প্রভু ভাবের হাসিটা নেই। পোশাক মলিন। তেজী শুধু কণ্ঠস্বর_তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে চাঙ্গা হবি।
যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে?
জবাব না দিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে চুনি বল্লো, অত খবরে তোর কী কাজ! তোর কাজ আমায় খুশি করা।
মানে?
ঐ শালা মুক্তিরা যখন পুরনো আস্তানায় হামলা করল, আমাকে ধরা কি সহজ কাজ! পালাবার সময় তোকে পিঠে নিয়ে পালালাম।
আমাকে?
তুই ছাড়া অক্ষত শরীরের মেয়ে তখন কেউ ছিল না। পাঞ্জাবী শালারা মুক্তিদের কামড়ে খতম। সুতরাং তুই এখন আমার খোরাক। এ তল্লাটে এখনো ফাইট হচ্ছে।
হিংস্র জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কমান্ডার চুনি।
কত দিন। কত রাত গেছে বুঝতে পারেনি সখিনা। পরিপূর্ণ জ্ঞান এসেছে হাসপাতালে। পাশে বসে মাহমুদ। বিশ্বাস হয়নি। ঘোর কাটেনি বাস্তব দুঃস্বপ্নের। কিন্তু শুনেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে মাহমুদের মুখ ভারির খবরটা তখনো জানা হয়নি। পাক সেনাদের রাজাকারদের জান্তব অত্যাচারে প্রাণ গেলে সে শহীদের মর্যাদা পেত। এখন জুটেছে বীরাঙ্গনার বিড়ম্বনা, মুখে, পত্রপত্রিকায় সে যা-ই বলুক বাস্তবে গ্রামে ফিরে টের পেল সবাই তাকে 'দুরছাই'-এর নজরে দেখছে। অসময়ে নিহত স্বামীর কষ্ট, জখমী শরীর_সব যন্ত্রণা দুঃখকে বুঝি ছাড়িয়ে যেতে চাইছে বীরাঙ্গনা খেতাব। বাঁচার মতো কি আর হাতে থাকল? ঠিক করেছিল আত্মহত্যা করবে। মাহমুদ যেন বুকের ভিতরটা পুরোই দেখতে পায়। গ্রাম থেকে চিকিৎসা করতে নিয়ে এল ঢাকায়। সেখান থেকে দুস্থ নারী কল্যাণ দপ্তরে। সুস্থ হয়ে সে আর গ্রামে ফিরে যেতে চাইলো না। অনিচ্ছুক জীবনযাপনে অপার বিতৃষ্ণা। সাময়িকভাবে দুনিয়া এবং মানুষ সবই মনে হতো অগ্রাহ্য।
মাহমুদ বোঝাল, অবলম্বন ছাড়া একা মানুষ বাঁচতে পারে না।
বাঁচতে তো চাই না। বেঁধে রেখে বাঁচিয়ে রেখেছ। ক্যান দিলে না মরতে? জাহান্নাম যদি পরকালে থাকে, ইহকালের এই যন্ত্রণা থেকে সে কি আর ভয়ংকর। যদি হয় তাও আমি সেখানেই যেতে চাই।
বুকে আঘাত করতে করতে প্রলাপের মতো বকত, দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার স্বাদ ক্যান পাচ্ছি না মিয়া ভাই!
আরও একটি সত্য তার জন্যে হয়ে গেছিল, সে কখনো মা হতে পারবে না। ভিতরের জখম এত গুরুতর ছিল। মাহমুদ বলেছিল, সখিনা তুই চাকরি করবি? চাকরি?
ক্লাস এইট পাস একটি মেয়েকে কে দেবে?
ব্যবস্থা করে যাবে। হাসপাতালের নার্সিং। যাবি?
মাথা নেড়েছিল শুধু। কাজে যোগ দিয়ে দৃষ্টি বদল হয়েছিল। নিজেকে মনে হয়েছিল খুব প্রয়োজনীয় মানুষ। আহা কী অসহায় চোখে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে রুগ্ণ শয্যার রোগীরা। কত কাঙ্ক্ষিত সে। তবু খবরের কাগজে নিয়মিত খোঁজ রাখত সেই পাষণ্ড বঙ্গসন্তানের। নাম যার চুনি মিয়া। মাহমুদ বলেছিল, হয় নিহত হয়েছে নয় পালিয়েছে।
বছর দশ পর সে-ই খবর দিল_ভোল পাল্টে নামের আগে অন্য নাম ব্যবহার করে সে শুধু বেঁচে নেই, টিকে আছে বহাল তবিয়তে। ঐ রাজাকারের গুষ্টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। ওদের পুলিশ দ্যাখে তো বিচারক বিচার করতে পারে না। সাধারণে যত ঘৃণিতই হোক ক্ষমতার জোরে নেতার ভূমিকায় ভালো ভালো কথা বলে বেড়ায়। হরহামেশা ওদের ফোন করে থাকে চাটুকারেরা। একসময় হয়তো দেখা যাবে এই রক্ষা কুণ্ডুলী সরকারি বাহিনীর। তার আগে... আলোর মিছিলের প্রথম পাতায় চুনির ছবি। অবসরপ্রাপ্ত সেবিকা সখিনা উঠে দাঁড়াল। বহু দিনের লালিত পাঁজরে জ্বলা তীব্র তাপ অনুভব করল নতুন করে। তার কিছু হলেও মিতার ক্ষতি হবে না। আসলে সে তো ফুপু। মিয়া ভাই মাহমুদ ওকে শিশুকালে কোলে তুলে দিয়েছিল সঙ্গী হিসাবে। কিন্তু সখিনার বিশ্বাস, ভালোভাবে কাজ পেয়ে সে ফিরে আসবে এই বাড়িতেই। প্রতীক্ষায় প্রহর ব্যর্থ হতে দেবে না।
পঁয়তালি্লশ বছরের ঈষৎ স্থূল শরীর চাদরে ঢেকে পেটের কাছে লুকিয়ে নিল। সেই তীক্ষ্ন ছোট্ট ধারালো ছুরিটা যা দীর্ঘদিন যত্ন করে সংগ্রহে রেখেছিল। নাকের ডগায় সেটা তুলে একা ঘরে বলল, তুই আমার বন্ধু কিনা, আজ পরিচয় দিবি।
মেয়েদের স্কুলে তখন লোকে লোকারণ্য। মঞ্চে বসে চাপ দাড়ি মুখে, কপালে নামাজির ইয়া বড় কালচে টিপ নিয়ে অনুসারী পরিবৃত্ত সেদিনের নরঘাতক বিশ্বাসঘাতক চুনি মিয়া। একালের আলহাজ জনদরদী খালেকুজ্জামান চুনি মিয়া...
মহিলাদের কাছে যেতে বারণ নেই। তারা আদাব সালাম জানাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে একসময় একদম কাছে চলে যাওয়া। কদমবুসি করার সময় ডান হাত নিল পেটের কাছে। তারপর চিন্তায় নিয়ে এল হাসপাতালের ওটির ধারে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে ধারালো ছুরি। এক টানেই সখিনা পারল তথাকথিত নেতার পেটের এপার থেকে ওপারে ছুরি চালাতে। বিষয়টি বোঝার আগে, হৈ চৈ প্রবল হবার আগে সখিনা বেশ স্থির পায়ে বেরুতে পারল। রিকশায় উঠে সোজা বাড়ি।
মিতাকে বলল, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমালে ডাকিস না।
কোথায় গেছিলে না বলে?
মিতার কণ্ঠস্বর পেছনে রেখে বিছানায় এসে শুলো। সত্যি বহু দিন পর শান্তির ঘুম আসছে। চোখের ওপর জীবন্ত হয়ে উঠছে পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা যুদ্ধের সময়ের একটি পোস্টার। ধিকৃত ইয়াহিয়ার ছবির সঙ্গে যাতে স্লোগান থাকত_এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.