জাতীয় কাজ, স্থানীয় কাজ ও স্থানীয় সরকার তাঁরা বোঝেন কি?

এক. কোনো দেশের সব কাজই জাতীয় নয়। আবার সব কিছুকেই স্থানীয় কাজ নামেও অভিহিত করা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ নামে প্রধানত দুই প্রকারের কাজ রয়েছে। কিন্তু এই কাজগুলো নির্দিষ্ট কারণসহ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষমতা কোনো একক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করা নেই।
স্থানীয় সরকার কর্তৃক স্থানীয় কাজগুলো করার কথা বলা আছে। অথচ বাস্তবে স্থানীয় সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের বর্ধিত শাখা হিসেবে কাজ করে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে একটি মাত্র সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকায় সব কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকেই করতে হচ্ছে। মজার বিষয় হলো, এসব তথ্য জানা থাকার পরও কিছু লেখক-বুদ্ধিজীবী নগরের সমস্যার জন্য সিটি করপোরেশন/পৌরসভাকে দায়ী করছেন। তথাকথিত স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বিদ্যমান ব্যবস্থা অটুট রেখে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সমাধান খুঁজছেন। এনজিওগুলো দাতাদের টাকা হালাল করার জন্য 'আন্দোলন-আন্দোলন' খেলা খেলছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশি-বিদেশি পুরস্কারও পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ সুনির্দিষ্টভাবে করার জন্য দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থাই সমাধান দিতে পারে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য সাম্প্রতিককালের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক।
দুই. নুরুল ইসলাম বিএসসি একজন স্বনামধন্য কলাম লেখক ও বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্য। তিনি সম্প্রতি একটি কলামে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (যুগান্তর, ২৮ জুন '১২)। অথচ সবার জানা রয়েছে, এ সমস্যাটি চট্টগ্রাম নগরের স্থানীয় সমস্যা। এটি নিরসনে চট্টগ্রাম নগরকে একক ক্ষমতা দেওয়া থাকলে ভালো ফল পাওয়া যেত। জনগণ তখন নগর কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে মিছিল-মিটিং করত। বর্তমানে কাজটি যৌথ থাকায় নগর করপোরেশন কেন্দ্রীয় সরকারকে এবং কেন্দ্রীয় সরকার নগর করপোরেশনকে দায়ী করে অর্পিত দায়িত্ব শেষ করছে। নুরুল ইসলাম বিএসসি এমপিও কাজটি সম্পাদন করার জন্য উভয় কর্তৃপক্ষকে আরো সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এটা নতুন কী! এর প্রায় দুই বছর আগে সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি ঢাকা মহানগরীর রাস্তাঘাটের দুরবস্থা দেখে সেগুলো সংস্কার করার দায়িত্ব ঢাকা নগরী থেকে নির্বাচিত এমপিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা কেউই স্থানীয় সরকার কার্যকর হোক, কামনা করেন বলে মনে হয় না। ধরা যাক, এ দেশের জন্য একটি মাত্র সরকার অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থাই সঠিক। তার পরও কি আইন বিভাগের সদস্যদের হাতে প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজ ছেড়ে দেওয়া গণতন্ত্রসম্মত হবে? অর্থাৎ তাঁরা ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্ব বোঝেন কি না প্রশ্ন করা যেতে পারে। সম্প্রতি একটি এনজিও বেলার কর্ণধার পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য 'র‌্যামন ম্যাগসাইসাই' পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে পাহাড় রক্ষা, নদী রক্ষা, শব্দদূষণ দূর করা ইত্যাদি বিষয়ে কিভাবে আইনি লড়াই করেছেন, তার বর্ণনা দেন। কিন্তু তিনি একটিবারও বলেননি যে এসবের অধিকাংশই স্থানীয় কাজ। সে জন্য এগুলো রক্ষায় স্থানীয় সরকারের হাতে একক ক্ষমতা দেওয়া উচিত। আবার প্রথম আলো পত্রিকা গত ৩০ জুলাই রংপুর নগরে 'কেমন সিটি করপোরেশন চাই' শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। ওই সেমিনারে সেখানকার জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ সুশীল সমাজের সদস্যরা বক্তব্য দেন। তাঁরা রংপুর নগরের লোকসংখ্যা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা, রাস্তাঘাটের অবস্থা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থার কথাসহ নগরকেন্দ্রিক স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা তুলে ধরেন। কিন্তু কেউই নগরের স্থানীয় সমস্যাগুলো দূর করার জন্য রংপুর নগর কর্তৃপক্ষ তথা নগর সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। সেই সঙ্গে জাতীয় কাজগুলো কিভাবে সম্পাদিত হবে, জেলার সঙ্গে নগরের কী সম্পর্ক থাকবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও বলেননি।
তিন. জাতীয় ঈদগাহ থেকে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করে বের হয়ে জনৈক মুসল্লি বলেন, 'এবার জাতীয় ঈদগাহে চমৎকার ডেকোরেশন করা হয়েছে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।' অনেকের জানা আছে, জাতীয় ঈদগাহর ডেকোরেশনের দায়িত্ব প্রধানত ঢাকা (দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের। কিন্তু এ কাজটি সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগকে বহু বছর ধরে সহযোগী ভূমিকায় থাকতে দেখা যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য সিটি করপোরেশনের ঈদগাহগুলোর ডেকোরেশন সিটি করপোরেশনগুলো এককভাবেই করে থাকে। ওই মুসল্লির এত কিছু জানা না থাকার কথা নয়। তাঁর অভিজ্ঞতায়, তিনি সব স্থানীয় কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বই দেখে আসছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ প্রকাশ ঘটিয়েছেন মাত্র। অন্যদিকে এনজিওগুলোর কোনোটিই বলছে না, আইন করে জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ পৃথক করে দিতে হবে, এবং কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার জন্য একক কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। সে জন্য আমরা বারবার বলে আসছি, এ দেশে প্রকৃত স্থানীয় সরকারের আন্দোলন এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারের সমন্বিত স্তরবিন্যাসসহ একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা সর্বপ্রথম সিডিএলজির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। এটির আলোকে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্যাম্পেইন, সভা-সেমিনার ইত্যাদি করে যাচ্ছে। অতি সংক্ষেপে বলা যায়, জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য পররাষ্ট্র, মুদ্রা, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য, সারা দেশের নিরাপত্তাসহ পাঁচ-ছয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নির্দিষ্ট থাকবে। আর অবশিষ্ট সব কাজ স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
চার. আমরা বিদ্যমান স্থানীয় কাজগুলো তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি, যেমন- ১. গ্রামীণ কাজ, ২. নগরীয় কাজ ও ৩. গ্রামীণ-নগরীয় কাজ। এই কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য স্তরবিন্যাস জরুরি। সিডিএলজির বিবেচনায় গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের নিম্নতম ইউনিট তথা ভিত্তিমূল হবে ইউনিয়ন এবং নগরের স্থানীয় ভিত্তিমূল হবে পৌরসভা/সিটি করপোরেশন/ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড নামের ইউনিটগুলো, আর সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে বিভাগ কিংবা জেলার কাজ হবে গ্রামীণ-নগরীয়। বর্তমানে জেলা ও উপজেলার আয়তনের মধ্যে নগরগুলো থাকায় এগুলোর চরিত্রও গ্রামীণ-নগরীর। সে জন্য গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো করার জন্য বিভাগ কিংবা জেলা- যেকোনো একটি ইউনিটকে বেছে নেওয়াই হবে যুক্তিযুক্ত। যদি বিভাগকে সর্বোচ্চ ইউনিট নির্ধারণ করা হয় তাহলে জেলা ও উপজেলার আয়তন থেকে নগরগুলো বের করে দিতে হবে। আর যদি বিভাগকে অপ্রয়োজনীয় স্তর মনে করা হয়, তাহলে সেটি বিলুপ্ত করে তদস্থলে জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু উপজেলার আয়তন থেকে নগরগুলো বের করে দিতে হবে। এরূপ স্তরবিন্যাসের সুবিধা হলো- ইউনিয়নগুলো ক্রমান্বয়ে নগরে রূপান্তরিত হতে হতে পুরো দেশ একসময় অনেক নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে। তখন বিভাগ কিংবা জেলা নগরগুলো তত্ত্বাবধান করবে।
পাঁচ. বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। সে জন্য এ দেশকে এখন আর পল্লী সমাজের দেশ বলা যায় না। বলা উচিত গ্রামীণ-নগরের বাংলাদেশ। যদিও পাঁচ কোটি লোক কোনো পরিকল্পিত নগরে বাস করছে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পুরো জনগোষ্ঠী নগরে বাস করেও আধুনিক জীবনযাপন থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হবে। সে কারণে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য স্থানীয়দের সম্পৃক্ত ও ক্ষমতায়িত করতে হবে। আর প্রতিটি ইউনিটে গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো প্রতিস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে পাহাড় রক্ষাসহ জেলাকেন্দ্রিক কাজগুলো সম্পন্ন করবে জেলা সরকার। জেলা সরকার বাস্তবায়িত হলে পাহাড়িদের জন্য পৃথক পার্বত্য আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। নগরীয় কাজগুলো সম্পন্ন করবে নগর সরকার এবং গ্রামীণ কাজগুলো করার জন্য দায়িত্ব পালন করবে ইউনিয়ন সরকার ও উপজেলা সরকার (যদি গ্রামীণ কাজগুলো করার জন্য উপজেলাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়)।

লেখকবৃন্দ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং সদস্য, সিডিএলজি
janipop1995@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.