যুদ্ধাপরাধ-বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর হোক by আবু সাঈদ খান

যুদ্ধাপরাধীর বিচার একটি জাতীয় ইস্যু। এটি নিয়ে হীন রাজনীতি কাম্য নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে। যখনই সরকারের কোনো অনিয়ম-ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ওঠে, তখনই সরকারের মুখপাত্ররা বলতে থাকেন_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর আন্দোলন হচ্ছে।


এভাবেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা হচ্ছে। ভিন্ন ইস্যুতে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর সঙ্গে মেলানো হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক জিইয়ে রাখবে, যা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না


একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দৃশ্যত আর কোনো বাদ-প্রতিবাদ নেই এখন। ইতিহাসের কলঙ্কমোচন ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন সর্বস্তরের জনতা। তবে এ ব্যাপারে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান দৃঢ় নয়। দলটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা থাকার পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার নয়। একাত্তরের অপকর্মের নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ তারা ছাড়ছে না। এ প্রসঙ্গে যা যা বলা হচ্ছে, সেসবের মানে এই_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের আপত্তি নেই। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য স্বচ্ছতার ব্যত্যয় ঘটেছে এমন কোনো প্রমাণ বিএনপি বা অন্য কোনো মহল থেকে দেওয়া হয়নি। তারপরও বলতে হয়, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
সঙ্গত কারণেই মুক্তিযোদ্ধা-জনগণের প্রত্যাশা, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলিমসহ দলের মধ্যে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দল থেকে বহিষ্কার করবে। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় না দাঁড়ালেও চিহ্নিত রাজাকাররা দলটির বিভিন্ন কমিটিতে পদ-পদবি নিয়ে রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কাজ হবে, তাদের দল থেকে বিদায় করে দেওয়া। দল ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করা সকল দলেরই কর্তব্য।
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে_ এ জন্য এর আগেও সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছি। আবারও জানাই। তবে বিচারের যে আয়োজন তা কি যথেষ্ট?
এখন মামলা চলছে মাত্র দুটি ট্রাইব্যুনালে। সেখানে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ১০-১২ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের দ্রুত কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার। সে ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে ট্রাইব্যুনালের লোকবলের অভাব। ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রতিটি জেলাতেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। তবে সে সময়েও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকেই ভালো মানুষ সেজে আছে, তাদের বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দেবেন, তারাও মারা গেছেন। এমন অনেককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন। তবে বিশেষভাবে চিহ্নিত ও কুখ্যাতদের বিচারের জন্যও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। তা না করে নীতিনির্ধারকরা যদি ভেবে থাকেন যে প্রতীকী বিচার করবেন অর্থাৎ কয়েকজনের বিচার করে কর্তব্য সমাধা করবেন_ সেটি হবে অনেক সন্তানহারা মা কিংবা বাবা, স্বামীহারা জায়া, পিতৃহারা সন্তানের প্রতি চরম অবিচার। অনেক শহীদ সন্তান বলছেন, আমার পিতার হত্যাকারীর কেন বিচার হবে না? অনেক শহীদ জায়া বলছেন, 'আমার স্বামীকে যারা ধরে নিয়ে গেছে, তাদের আস্ফালন আর সইতে পারি না।' এর কী জবাব দেবেন নীতিনির্ধারকরা। সেই বিবেচনায় অবিলম্বে আরও দু'তিনটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এর আগে বিদ্যমান ট্রাইব্যুনাল দুটির লোকবলসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। মাত্র ১৩ কেঁৗসুলি এবং ১৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সংখ্যা অপ্রতুল। তাছাড়া দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে_ এমন কয়েকজনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেঁৗসুলি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের বসার স্থান, যানবাহন, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট না দেওয়ায় কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রধান ভিত্তি হচ্ছে দালিলিক প্রমাণ। এমন প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ, সংবাদপত্র, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে রয়েছে। তা সংগ্রহ করে তথ্য ও গবেষণা সেল গঠন এবং গবেষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। কিন্তু এই জরুরি কাজটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ, আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তদুপরি নিরাপত্তার সংকটে ভুগছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কী করে তারা স্বচ্ছন্দচিত্তে কাজ করবেন? সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব বিষয় বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা হলেও পর্যাপ্ত সাড়া মিলছে না।
এ অব্যবস্থাপনা গ্রহণযোগ্য নয়। এর পেছনে বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার মানসিকতার যোগসূত্র থাকতে পারে, এমন সন্দেহও অমূলক নয়। শোনা যাচ্ছে, মহাজোট সরকার বর্তমান মেয়াদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাও করতে পারে। এটি ঝুলিয়ে রেখে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা হতে পারে। এর মানে এই নির্বাচনে বলা হবে যে, 'আমাদের আরেকবার ক্ষমতা দিন, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের অসমাপ্ত বিচার শেষ করব।' বিচার বিলম্বিত করে একে নির্বাচনী ইস্যু করা হলে তা হবে আত্মপ্রতারণারই শামিল। আর সেটি সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার একটি জাতীয় ইস্যু। এটি নিয়ে হীন রাজনীতি কাম্য নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে। যখনই সরকারের কোনো অনিয়ম-ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ওঠে, তখনই সরকারের মুখপাত্ররা বলতে থাকেন_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর আন্দোলন হচ্ছে। এভাবেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা হচ্ছে। ভিন্ন ইস্যুতে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর সঙ্গে মেলানো হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক জিইয়ে রাখবে, যা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। দেশের সচেতন নাগরিকরা যেমন সরকারের এই ভ্রান্ত কৌশলের সমালোচনা করে, তেমনি প্রধান বিরোধী দলের জামায়াতের সঙ্গে জোট করে সরকার হটানোর নীতিও সমর্থন করে না। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল কৌশলের খেলা ছেড়ে নীতির প্রতি আনুগত্য দেখাবে, সেটি কাম্য। কৌশলের যূপকাষ্ঠে যখন নীতি বলি হয়, তখন সেই কৌশল অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীর বিচার চাই, সে সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নিরপরাধ নেতাকর্মীদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত রাখারও দাবি করি। বিশ্বাস করি, জাতীয় নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদেরও রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার পেতে পারে না। লাখো শহীদের রক্তস্নাত মাটিতে একাত্তরের পরিত্যক্ত ভাবাদর্শ নিয়ে রাজনীতি হতে পারে না। একাত্তরে জামায়াত অনেক অপকর্মের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সজ্ঞানে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সে কারণেও দলটিকে নিষিদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান নেতিবাচক।
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ বন্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ রহিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আধা-সামরিক শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীর ওপর রায়ে ৩৮ অনুচ্ছেদটি পরিপূর্ণভাবে পুনরুজ্জীবিত করায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ ছিল না। কিন্তু সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দিয়েছে এবং রেখে দিয়েছে সংবিধানের শিরোনামে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বিধান। কারও অজানা নেই যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের ফরমানে সংবিধানের শিরোনামে বিসমিল্লাহ এবং জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সেক্যুলার মূল্যবোধের পরিপন্থী। আমি বুঝে উঠতে পারি না, বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনের হাতে তৈরি বিধান মুছে দিয়ে সরকার কেন জিয়া-এরশাদের বিধান রক্ষা করছে? তবে কি ৭২-এ সংবিধানে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনসহ মুক্তিযোদ্ধা_ নেতারা ভুল করেছিলেন?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের যে রাজনীতি ছিল, তা-ই এখন পুনরুৎপাদিত হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য মৌলবাদী সংগঠনগুলোর কারখানায়। আর তাদের মাথার ওপর ফুটে আছে রাষ্ট্রধর্মের ছাতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এমন কারখানাগুলো খোলা রেখে, ছাতা না বুজিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসর হওয়া কি আদৌ সম্ভব?

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.