বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন by এ এম এম শওকত আলী

বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি উন্নয়নের অতীত-বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ৫ মে । এতে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে বৃষ্টির অভাব ও অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে কৃষি উন্নয়ন এখন হুমকির মুখে। কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য বিজ্ঞানীরা সারা দেশে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল চিহ্নিত করেছেন।


বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ফার্টিলাইজার রিকমন্ডেশন গাইড শিরোনামে প্রকাশনায় ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের তালিকা পাওয়া যাবে। এ প্রকাশনায় কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে কোন ফসলে কী ধরনের এবং কী মাত্রায় সার ব্যবহার করা হবে তার সুপারিশও দেওয়া আছে। প্রকাশনায় একটি বিষয় স্বীকৃত। তা হলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র আকৃতির জমির মালিকানাহেতু ৩০টি অঞ্চলের ভূমির উর্বরতার যথেষ্ট তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে ওই প্রকাশনায় যে সুপারিশ করা হয়েছে তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। এ প্রকাশনায় ভূমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বরেন্দ্র অঞ্চলকে তিনটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তিনটি অঞ্চল হলো- (১) কৃষি পরিবেশ অঞ্চল ২৫ সমতল বরেন্দ্র ভূমি। এর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলা, (২) বরেন্দ্র উচ্চ ভূমিসম্পন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চল ২৬ যার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী, নওয়াবগঞ্জ ও নওগাঁ, (৩) কৃষি পরিবেশ অঞ্চল ২৭ যা উত্তরপূর্ব বরেন্দ্র অঞ্চল নামে বর্ণিত। এর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও বগুড়া। বলা যায়, যে কয়েকটি জেলা আংশিকভাবে তিনটি বরেন্দ্র কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিস্তৃত।
কৃষির উন্নয়নের জন্য আশির দশকে বিএডিসি বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ কাজ মূলত গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ সুবিধা প্রদানের মধ্যেই সীমিত ছিল। যে অঞ্চলে সম্ভব সেখানে অগভীর নলকূপও বসানো হয়। ওই সময় বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল যে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়। এ নিয়ে ভিন্ন মতও অনেকের ছিল।
বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনই প্রধান ফসল ছিল। গভীর নলকূপ সীমিত ব্যবহারের ফলে কিছু বোরো ধানও চাষ করা হতো। নওয়াবগঞ্জ জেলার মহানন্দা নদীর পানি ও শক্তিচালিত পাম্প ব্যবহার করে বোরো ধানের চাষ হতো। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের জন্য যাদের মত ছিল ওই মহল থেকেই দাবি আসে, একটি পৃথক বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে কৃষিসহ সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার। এ বিষয়ে বলা প্রয়োজন যে বরেন্দ্র কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প প্রাথমিক পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন দেয়নি। ১৯৮৫-৮৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ প্রকল্প অনুমোদনের পক্ষে ছিলেন।
পরিকল্পনা কমিশনের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত জানার পর তিনি রাজশাহীর তদানীন্তন কমিশনারকে আবার প্রকল্প দলিল প্রণয়নের অনুরোধ জানান। ওই কমিশনার আগে বিএডিসিসহ কৃষি মন্ত্রণালয়েও কাজ করেছিলেন। এ কারণেই হয়তো তাঁকেই এ অনুরোধ জানানো হয়। অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কমিশনার বিএডিসির সদর অফিস থেকে তিন কর্মকর্তাকে এ কাজে সহায়তার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন সেচ প্রকৌশলী এবং অন্যজন কৃষি অর্থনীতিবিদ। পরিকল্পনা কমিশন পূর্ববর্তী প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করার জন্য যেসব প্রশ্নের অবতারণা করেছিল তার বিপরীতে পাল্টা যুক্তি প্রদান করা হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পও পরে গঠিত হয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি অনুমোদন করে। প্রকল্প দলিলে বিআইডিসির একটি ইতিবাচক মূল্যায়নও সংযোজন করা হয়েছিল।
নতুন অনুমোদিত প্রকল্পের মধ্যে কৃষি উন্নয়ন ছাড়াও গ্রামীণ রাস্তাঘাটসহ সুপরিবেশ সহায়ক বৃক্ষ রোপণের পরিকল্পনা ছিল। আর ছিল ওই অঞ্চলের সরকারি হাজামজা জলাশয়ের পুনর্খনন যা মাছ চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি পৃথক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন হওয়ার পর বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়ন যে ত্বরান্বিত হয়েছে সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দে নেই। প্রাথমিকভাবে প্রকল্প এলাকা রাজশাহী, নওয়াবগঞ্জ ও নওগাঁর মধ্যে সীমিত ছিল। পরে এর বিস্তৃতি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলায় কম-বেশি করা হয়েছে। এ বিস্তৃতির ফলে ওই সব অঞ্চলে বিএডিসির কার্যক্রমও সঙ্কুচিত হয়।
বরেন্দ্র প্রকল্প নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এর মূল কারণ ছিল গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থাপনার অভিনব পন্থা। এ ক্ষেত্রে বিএডিসি সনাতনী পদ্ধতিতে সেচ সুবিধাভোগী কৃষকদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের কৌশল অক্ষুণ্ন রাখে। বাস্তবে ভাড়া আদায় ছিল নগণ্য। এ কারণে যে বিএডিসি এক সময় দাতাগোষ্ঠীদের প্রিয়পাত্র ছিল, সে বিএডিসিই তাদের কাছে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিএডিসির জন্য উন্নয়ন সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, নব্বই দশকে বিভিন্ন প্রকল্পের শর্ত হিসেবে ক্ষুদ্র সেচসহ সার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে তদানীন্তন সরকার অবশ্য এসব কৌশল গ্রহণ করেনি। বরং সেচসহ সার ব্যবস্থাপনায় কিছু দায়িত্ব বিএডিসিকে দেওয়া হয়।
পক্ষান্তরে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেচ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ভাড়ার বদলে জ্বালানি তেলসহ কিছু আনুষঙ্গিক ব্যয় আদায় করতে সফল হয়। যদি কোনো গভীর নলকূপের পরিচালনা ব্যয় সুবিধাভোগীরা না মেটায় তাহলে সে নলকূপের পানি সেচের জন্য দেওয়া হবে না। এ নীতি কঠোর ও সফলভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এ কৌশল অবলম্বনের ফলে বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষকে সেচ যন্ত্রের আবর্তক ব্যয়ের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়নি। এ সফলতাই ছিল আশাব্যঞ্জক।
৫ মে প্রকাশিত সংবাদ এখন নতুন আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। সংবাদের প্রতিবেদক বরেন্দ্র অঞ্চল বৃষ্টির অভাব ও অত্যধিক তাপমাত্রার জন্য মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে তিনি জানান। তিনি বর্তমানে যা বলেছেন একই কথা অতীতে যেসব বিশেষজ্ঞ এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁরাও তখন একই কথা বলছিলেন। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে কারো দ্বিম নেই। এ পর্যন্ত কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য প্রভাব হবে বৃষ্টিপাত হ্রাসসহ তাপমাত্রার আধিক্য। এর কুফল কেবল কৃষিতেই সীমিত থাকবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে জনস্বাস্থ্যের জন্যও এটা একটা বিরাট হুমকিস্বরূপ।
বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের মাত্রা হ্রাস করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন। বিকল্প বলা হচ্ছে, ভূ-উপরিস্থ পানির অধিক ব্যবহার। এ বিষয়েও যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা কারো অজানা নয়। অবকাঠামো নির্মাণ উন্নয়নের সহায়ক। এতে দ্বিমত নেই। তবে এ স্লোগানের ভিত্তিতে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ মূলত রাস্তাঘাটসহ সেতু নির্মাণের মধ্যেই বহুলাংশে সীমিত। ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কি এর উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় না? যদি না যায় তাহলে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহারের বৃথা উপদেশ কেন?
এর সঙ্গে আরো একটি কৌশলের বিষয় সরকারি নীতিনির্ধারকরা বলে থাকেন। অনুমোদিত জাতীয় কৃষি বিষয়ক নীতিতেও একই কথা বলা হয়েছে। বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমনের চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। কিংবদন্তির হারকিউলিসও এ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূল কারণ বৃষ্টিপাত হ্রাস। শুধু বৃষ্টি হলেই হবে না। বৃষ্টি কৃষিনির্ভর অঞ্চলেই হতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ৫ অথবা ৬ মে রাজশাহী জেলার মাত্র দুটি উপজেলায় কিছু বৃষ্টি হয়েছে। আগামী আউশ ও আমন চাষের জন্য এ বৃষ্টিপাত যথেষ্ট নয়। আশু প্রয়োজন খরা সহিষ্ণু আউশ ও আমনের উচ্চ ফলনশীল বীজের। জানা গেছে যে সাম্প্রতিককালে ব্রি জন্মলগ্ন থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়ে সর্বমোট ৫৪টি উচ্চ ফলনশীল বীজ ও চারটি হাইব্রিড বীজ উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি ব্রিধান ৪২ ও ব্রিধান ৪৩ খরা সহিষ্ণু বীজ। তবে এরা বৃষ্টিবহুল এলাকার জন্যও উপযোগী। জীবনকাল মাত্র ১০০ দিন যা অন্যান্য উচ্চ ফলনশীল বীজের তুলনায় অনেক কম। তবে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের মাত্রা ৩.৫ টন। অন্যান্য উচ্চ ফলনশীল ধানের ফলন ৪ টন থেকে ৫.৫ টন। হাইব্রিড বীজের মধ্যে ব্রি হাইব্রিড ধান ৪-এর জীবনকাল ১১৮ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ৬.৫ টন। তবে এ ধান খরাসহিষ্ণু কিনা তা বলা হয়নি। বীজটি আমন চাষের জন্য।
সরকারি খাতে বীজ উৎপাদন বিএডিসির দায়িত্ব। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরাসরি কৃষকদের দ্বারা বীজ উৎপাদন করে থাকে। যে দুটি খরাসহিষ্ণু বীজের কথা বলা হলো সে সব বীজের উৎপাদন বিএডিসিসহ কৃষক পর্যায়েও করা গেলে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সম্ভাব্য কী পদক্ষেপ হতে পারে তা ভেবে দেখতে পারে। এ ছাড়া ১৯৯৬-২০০১ সালে ব্রিসহ অন্যান্য সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ব্রিডার সিডও দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ এ উৎস থেকে অতীতে ব্রিডার বীজ সংগ্রহ করেছে। কর্তৃপক্ষ খরাসহিষ্ণু ব্রিধান ৪২ এবং ব্রিধান ৪৩ ব্রিডার বীজ সংগ্রহ করে কৃষকদের দিতে পারেন। এর ফলে এ ধরনের বীজের ব্যবহার দ্রুততর হবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.