সংবিধানে জলবায়ু পরিবর্তন by জিয়াউল হক মুক্তা

গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযানের উদ্যোগে ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রতীকী জলবায়ু আদালত। আদালতের প্রথম লক্ষ্য ছিল, চলমান বহুপাক্ষিক জলবায়ু আলোচনার অনগ্রসরমানতার প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে দেশ ও জনগণের জন্য বিকল্পের অনুসন্ধান।


লক্ষ্য অর্জনে প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল, আদৌ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কি না। সে সূত্রে আয়োজনের দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের বাংলাদেশ নির্দিষ্ট বিজ্ঞান ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার ক্ষতির প্রমাণ উপস্থাপন করা। প্রতীকী আদালতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় বাংলাদেশের জলবায়ু বিজ্ঞানী ও আইনজীবীরা বিজ্ঞান, আইন ও চলমান বহুপাক্ষিক জলবায়ু আলোচনার তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তি উপস্থাপন করেন। আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত জুরি প্যানেল অভিযোগ, তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তি বিশ্লেষণসাপেক্ষে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরে। প্রতীকী আদালতের জুরি প্যানেল অভিমত ব্যক্ত করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিযোগকারীদের অন্তত একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে; জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, জাতীয় পরিসরে খাদ্যনিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এবং সংবিধানেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। সে জন্য প্যানেল অভ্যন্তরীণ পরিসরে সংবিধানে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে একটি বিশেষ ধারা সংযোজন করার সুস্পষ্ট আহ্বান জানায়; যা ভবিষ্যতে জাতিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করতে সক্ষম হবে। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের পক্ষ থেকেও অনুরূপ আহ্বান জানানো হয়েছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক যে স্বৈরশাসকদের হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত সংবিধানকে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে মূল রূপে ফিরিয়ে আনতে সরকার গঠিত বিশেষ কমিটি বিশেষজ্ঞ ও সংসদ সদস্যদের আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়েছে এবং সংবিধানে জলবায়ু পরিবর্তনকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ধরনের একটি ধারা সংযোজনের ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হবে বিশ্বে সর্বপ্রথম।
তবে সংবিধানে এ সংযোজনটি বিমূর্তভাবে রাখার কোনো অবকাশ নেই। তা হতে হবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিজ্ঞানের বিবেচনায় নিখুঁত ও নির্ভুল। সামান্য এদিক-সেদিক হলে সংশ্লিষ্ট ধারাটি উল্টো আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশকে বহুপাক্ষিক বিশ্বরাজনীতিতে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। সেসব বিবেচনায় সংযোজনের জন্য প্রস্তাবিত ধারাটি হলো : রাষ্ট্র মানব সৃষ্ট জোরালো বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র উপরিতলের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিঘাত মোকাবিলায় ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন হ্রাস ও অভিযোজনসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইংরেজিতে : The State shall take appropriate response measures, including mitigation, and adaptation, against anthropogenic accelerated global warming induced climate change and sea level rise and respective adverse impacts. ধারাটির শিরোনাম হতে পারে 'জলবায়ু পরিবর্তন'। প্রস্তাবিত ধারাটিতে প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যাতে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি না করে, সে জন্য মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে; এটা হচ্ছে 'কারণ'। 'বৈশ্বিক উষ্ণতা' হচ্ছে তার 'ফলাফল'। জলবায়ু পরিবর্তন আর সমুদ্র উপরিতলের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে 'লক্ষণ'; এখানে সমুদ্র উপরিতলের উচ্চতা বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের এমন একটি বিশেষ প্রভাব, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত এবং যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অধিকতর মাত্রায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনকারী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার। 'ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন হ্রাস ও অভিযোজনসহ যথাযথ ব্যবস্থা' হচ্ছে বর্ণিত কারণ, ফলাফল ও লক্ষণের প্রতিকারে রাষ্ট্রের করণীয়।
ধারাটি সংযোজন করতে হবে সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগে অথবা 'মৌলিক অধিকার' শীর্ষক তৃতীয় ভাগে। তবে যেহেতু সংবিধানের 'মৌলিক অধিকার' শীর্ষক তৃতীয় ভাগের 'মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ' শীর্ষক ধারায় ওই ভাগে প্রদত্ত অধিকারগুলো বলবৎ করার জন্য 'হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করিবার অধিকারের নিশ্চয়তা দান' করা হয়েছে, এবং 'বিচার বিভাগ' শীর্ষক ষষ্ঠ ভাগের 'কতিপয় আদেশ ও নির্দেশ প্রভৃতি দানের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা' শীর্ষক ধারা অনুযায়ী 'কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোন একটি বলবৎ করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত কোন দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন'; সেহেতু, বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ও অভ্যন্তরীণভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে সংসদ চাইলে জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক ধারাটি সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে সংযোজন করা যেতে পারে, যা 'মূলনীতিসমূহ' শীর্ষক ধারা অনুযায়ী 'আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না'। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পরিসরে জনগণের অভিযোজনের অগ্রাধিকার বিবেচনা করলে ধারাটি 'মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা' শীর্ষক ধারার একটি উপধারা হিসেবে সংযোজন করা যেতে পারে। তবে, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রসংশ্লিষ্ট এবং ধারাটি অভিযোজন ও নির্গমন কমানোসহ অপরাপর ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার নির্দেশ দেবে, সেহেতু এর অবস্থান হতে পারে দ্বিতীয় ভাগের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর সংযোগকারী ধারা হিসেবে, অর্থাৎ 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' শীর্ষক ধারার আগে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে।
আশা করা যায়, সংবিধানের মতো একটি পবিত্র নির্দেশনায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিমূর্তভাবে উপস্থাপিত হবে না, কেননা সংবিধানের বিমূর্ততা ভবিষ্যতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক আইনি বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংবিধান সংশোধন কমিটির সদস্যরা ও সংসদ সদস্যদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, প্রয়োজনে প্রস্তাবিত ধারাটি বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করুন এবং সেভাবে সংবিধানে সংযোজন করুন। একুশ শতকের এই বিশেষ চ্যালেঞ্জটি আপনাদের যোগ্য নেতৃত্বেই বাংলাদেশ মোকাবিলা করবে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রতীকী জলবায়ু আদালতের কার্যবিবরণী বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ ও ব্রাসেলসভিত্তিক আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত। সংবিধানের উদ্ধৃতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছে ১৯৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান থেকে; এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি এড়ানোর লক্ষ্যে ধারাগুলোর ক্রমিকসংখ্যার পরিবর্তে শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

লেখক : ম্যানেজার, পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি বিভাগ,
অঙ্ফাম, গ্রেট ব্রিটেন, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.