ফুলঃ- হেমন্তের নিশিপুষ্প হিমঝুরি by মোকারম হোসেন

হেমন্তের এক মিষ্টি সকাল। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের প্রবেশপথ অতিক্রম করার আগেই দৃষ্টি আটকে গেল ঝরে পড়া পুষ্পমেলায়। অসংখ্য ফুল শয্যা পেতেছে গাছতলায়। সেখান থেকে একটি ফুল তুলে গন্ধ শুঁকি। বাহ, বেশ সুগন্ধি তো! ওপরে তাকিয়ে দেখি, পত্রঘন সুউচ্চ একটি গাছ। আগে কখনো দেখিনি।
গাছটির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আরও কয়েকটি গাছের সন্ধান পাই। এখানে অপেক্ষাকৃত ছোট আরও দুটি গাছ ছিল। রেলিং দেওয়ার সময় কেটে ফেলা হয়েছে। নগরে নিসর্গ গ্রন্থে বিপ্রদাশ বড়ুয়া প্রথমোক্ত গাছটি সম্পর্কে লিখেছেন: ‘বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন বসু এ গাছের চারাটি কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে এনেছিলেন। তখন এখানে তাঁর বাসা ছিল।’ বলধা গার্ডেনের পাশে খ্রিষ্টান কবরস্থানের ভেতর বিভিন্ন আকারের কয়েকটি গাছ দেখা যায়।
মিয়ানমারের নিজস্ব এই বৃক্ষটি আমাদের দেশে এসেছে প্রায় ২০০ বছর আগে। সুদীর্ঘ সময় ধরে আমাদের জল-হাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ায় এখন দেশি গাছ হিসেবেই পরিচিত। একসময় এর মোটা বাকল থেকে নিম্নমানের বোতলের ছিপি বানানো হতো বলেই সম্ভবত কর্কগাছ নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশে এই গাছের নাম ‘কর্কগাছ’, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করেছেন ‘হিমঝুরি’। হিন্দি নাম ‘আকাশনিম’।
উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে এই গাছের স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে: ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা থেকে কলকাতা চলেছি ট্রেনে। নভেম্বর মাস। এক অখ্যাত স্টেশনে ট্রেন থেমে গেল। ক্রসিংয়ের ঝামেলা। সবাই প্লাটফর্মে নেমে দু’পা হেঁটে নিচ্ছে। আমি বসলাম একটি বেঞ্চে। হঠাৎ দেখি আমার গায়ে পাশের আকাশছোঁয়া একটি গাছ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি ফুল ঝরছে। মুহূর্তেই হিমঝুরি নাম মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া।’
হিমঝুরি (Millingtonia hortensis) সুউচ্চ চিরসবুজ বৃক্ষ। খাড়া ডালপালায় নোয়ানো আগা, ছোটখাটো ডালের মতো সরু পত্রিকাবহুল পক্ষাকার যৌগপত্র। ফুল মধুগন্ধী, ফোটে রাতে, ভোরের আগেই ঝরে পড়ে, শাখান্তের বড়সড় যৌগিক মঞ্জরিতে, ছাড়াছাড়া ভাবে। ফুলগুলো সাদা ও নলাকার। নলমুখে বসানো থাকে পাঁচটি খুদে পাপড়ির একটি তারা। ফাঁকে ফাঁকে আছে পাঁচটি পরাগধানী, যেন সযত্নে বসানো রত্নপাথর, সাদা বা হলুদ; গর্ভকেশরযুক্ত। ফলগুলো সরু, লম্বা, আগা ও গোড়া ছুঁচালো, সরু সরু পক্ষল বীজে ভরাট, এক ফুট বা ততোধিক দীর্ঘ। বীজগুলো ঈষৎ স্বচ্ছ পাখনাঘেরা এবং সে কারণেই উড়ুক্কু ও দূরগামী। এই গাছ ছায়াঘন নয় এবং শিকড় অগভীর হওয়ায় ঝড়ে উপড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই পথতরুর অনুপযোগী। বীজ ছাড়াও গাছের শিকড় থেকে গজানো চারা থেকেই বংশবিস্তার। কাঠ নরম, হালকা, হলুদ, মসৃণ এবং আসবাব ও সজ্জাকার্যের উপযোগী। ইন্দোনেশিয়ায় বাকলের তেতো রস থেকে জ্বরের ওষুধ বানানো হয়। হেমন্তে স্বল্প পুষ্পের বিপরীতে হিমঝুরির দীর্ঘ বীথি কিছুটা হলেও প্রকৃতির দীনতা ঘোচাবে।

No comments

Powered by Blogger.