ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের ১০ মামলাঃ ২৮০ টাকার ইনজেকশন কেনা হয় দুই হাজার ৯০ টাকায়

কিডনি রোগীদের জীবন রক্ষাকারী হ্যাপারিন ইনজেকশনের (৫০০০ ইউনিট) দাম ২৮০ টাকা। অথচ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ইনজেকশন কিনেছে দুই হাজার ৯০ টাকা করে। পাঁচ হাজার টাকার বাল্ব কেনা হয়েছে ১৯ হাজার ৯০০ টাকায়। কোটেশন পদ্ধতিতে এভাবে বিভিন্ন ওষুধ ও সামগ্রী কেনায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ছয় কোটি ৬৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গত বুধবার শাহবাগ থানায় এসব মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হক। মামলাগুলোতে আসামি করা হয়েছে হাসপাতালের সাবেক পরিচালক বজলে কাদের, উপপরিচালক ডা. ফয়জুল্লাহ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডা. মশিউর রহমান, উপপরিচালক ডা. কাজী এনামুল কবির, সহকারী অধ্যাপক ডা. আতিয়ার রহমান, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, সমাজসেবা কর্মকর্তা সাঈদা আখতার, গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক এবং রাজধানীর আরামবাগের মেসার্স এসএম এন্টারপ্রাইজের মালিক সমীরণ দাশগুপ্তকে।
মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের মাধ্যমে বিল দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে—এ মর্মে দুদক বুধবার ১০টি মামলা করেছে। দুদক মামলাগুলো দায়েরের বিষয়ে মঙ্গলবার অনুমোদন দেয়।
মামলাগুলোর এজাহারে বলা হয়, হাসপাতালের কিডনি রোগীদের জন্য সাত হাজার ৪০৯টি হ্যাপারিন ইনজেকশন (৫০০০ ইউনিট) কিনতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে এক কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার ২৯০ টাকার বিল বেশি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী এ ইনজেকশনের প্রতিটির দাম ছিল ২৮০ টাকা। কিন্তু মেসার্স এসএম এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ইনজেকশন কেনে দুই হাজার ৯০ টাকা দরে। একই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চারটি কার্যাদেশের মাধ্যমে ১০০টি ‘হ্যানোলাক্স ব্লু’ বাল্ব কেনা হয় ১৯ হাজার ৯০০ টাকা করে। কিন্তু এর একটির বাজারদর পাঁচ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে এক বছরে এসএম এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয় এক কোটি ৫৪ লাখ ২৯০ টাকা।
কোনো দরপত্র ছাড়া অস্বচ্ছ কোটেশনের মাধ্যমে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের মেডিকম ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে হাসপাতাল সামগ্রী কেনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এক কোটি ৩৬ লাখ ২২ হাজার টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আসামিরা তোপখানা রোডের মেসার্স এসএ সার্জিক্যাল থেকে ভারতীয় হ্যাক্সারিন ক্রিম কিনতে আত্মসাৎ করেছেন ১০ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৪ টাকা। যে ক্রিমের বাজারমূল্য চার লাখ ৪৯ হাজার ১০০ টাকা, কর্তৃপক্ষ তার বিল করেছে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৪ টাকা। মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার মেসার্স ভূঁইয়া করপোরেশনের কাছ থেকে ৪০টি ১৮জি ভেরিয়েবল এক্সটেনশন কম্বাইন্ড স্পাইনাল ইপাইডুরাল কিট কেনা হয়। এগুলোর প্রতিটির দাম ৮৫ টাকা। কিন্তু বিলে প্রতিটির দাম দেখানো হয় ১০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে আসামি চক্র তিন লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বাংলাবাজারের পিকে রায় রোডের মেসার্স হাবিব করপোরেশনের কাছ থেকে ১৫০ ওয়াটের (৬৪৬৪০) ২০০টি বাল্ব কিনতে আত্মসাৎ করা হয় ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২৫ টাকা দরের ২৪ ভোল্টের বাল্ব (পিন টাইপ-৬৪৬৫০) কেনা হয় নয় হাজার ৯০০ টাকা করে। ১৫০টি বাল্বে আত্মসাৎ করা হয় ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৫০ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে আরও ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আত্মসাতের জন্য তৃতীয় পর্যায়ে ২৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার ১৩০ ওয়াটের বাল্ব কেনা হয়। তিন ধাপে এ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে হাসপাতাল সামগ্রী কেনার নামে ৪৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। দক্ষিণ গোড়ানের মেসার্স জাকিয়া এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে তিন ধরনের ওষুধ কেনার নামে ১৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। উত্তর মৈশুন্ডির মেসার্স কনস্ট্যান্ড ট্রেড ভিউর কাছ থেকে দুই দফায় ওষুধ কেনায় ১৭ লাখ ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণির ভূঁইয়া মেডিকেল হলের কাছ থেকে ওষুধ কেনায় ২৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, মিটফোর্ডের এইচএন সার্জিক্যালের কাছ থেকে ইসিজি মেশিনের সার্কিট, বিভিন্ন ধরনের পেপার ও তিন ধরনের ওষুধ সামগ্রী কেনায় দুই কোটি ৩১ লাখ ৮২ হাজার টাকার দুর্নীতি করা হয়।
মেসার্স ভূঁইয়া করপোরেশনের কাছ থেকে কয়েক ধরনের সামগ্রী কেনায় ১৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা আত্মসাৎসহ মোট ছয় কোটি ৬৩ লাখ ২৯ হাজার টাকার দুর্নীতি করা হয়।
বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্র্যাকটিক্যাল ফার্মেসির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডা. মশিউর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শত্রুতাবশত কেউ তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দুদককে জানিয়েছে। এর সব মিথ্যা।
বক্তব্য জানতে বারবার চেষ্টা করেও উপপরিচালক ডা. ফয়জুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.