বামে ঘুরছে জাপান -সময়ের প্রেক্ষিত by মনজুরুল হক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু হওয়া স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি পর্বের সূচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে চলা সেই ছায়াযুদ্ধে কামান দাগা না হলেও যেকোনো মুহূর্তে পরমাণু সংঘাত শুরু হয়ে যাওয়ার মতো ভয়ঙ্কর আশঙ্কা তখন প্রায় পুরো সময় বিরাজমান ছিল। আর সে রকম সমর প্রস্তুতির মুখে বিশ্ব হয়ে পড়েছিল টানা এক বিভক্তিরেখা বরাবর দুই শিবিরে বিভক্ত—যার একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্বের জোট আর অন্যদিকে ছিল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া এবং সমাজতন্ত্রের বিদায়-পর্বের সেই বিভাজনকে অর্থহীন করে তোলায় বিশ্বজুড়ে শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞাতেও বড় ধরনের রদবদল পরবর্তী সময়ে হতে দেখা যায়। সোভিয়েত নেতৃত্বের অনেক দেশ যোগ দেয় মার্কিন আধিপত্য বলয়ে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘খাস তালুক’ হিসেবে গণ্য হয়ে আসা লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ বের হয়ে আসে আগের সেই প্রভাব বলয় থেকে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের হিসাব-নিকাশের অনেকটাই এর ফলে যায় বদলে। তবে রদবদলের সেই হাওয়া পূর্ব এশিয়ার যে দুটি দেশকে প্রায় দুই দশক ধরে আলোড়িত করতে পারেনি, সেই দেশ দুটি হচ্ছে জাপান ও উত্তর কোরিয়া। ১৯৯১ সালের পরও জাপান থেকে যায় নব্য-উদার অর্থনীতির বাজার মৌলবাদী ব্যবস্থা অনুসরণ করে যাওয়া এক দেশ, কৌশলগত দিক থেকে যে অব্যাহত রাখে মার্কিন নিরাপত্তা ছত্রচ্ছায়া ভোগ করা। উত্তর কোরিয়া অবশ্য অনুসরণ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি তাই পূর্ব এশিয়ার এই দুটি দেশকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারেনি, যাদের সরকারি নেতারা এরপরও দীর্ঘদিন ধরে গতানুগতিকভাবে জপে গেছেন স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের সেই একই পুরোনো বুলি।
তবে ৩০ আগস্টের নির্বাচনের পর থেকে দিনবদলের যে হাওয়া জাপানে এখন বহমান, তা হয়তো দেশটিকে শেষ পর্যন্ত বের করে আনবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মনমানসিকতায় পরিপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বেড়াজাল থেকে। জাপানের জন্য সম্ভাব্য এই পরিবর্তন তাই হচ্ছে আসলেই সুদূরপ্রসারী।
জাপান হচ্ছে অগ্রসর গণতান্ত্রিক কাঠামো চালু থাকা বিশ্বের একমাত্র দেশ, দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আধিপত্যে কোনোরকমে রদবদল যেখানে প্রায় দেখা যায়নি। ‘প্রায়’ শব্দটির প্রয়োগ এ কারণে যে ১৯৯৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপি একবার মাত্র অল্পসময়ের জন্য ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। তবে হারানো সেই ক্ষমতা ফিরে পেতে বেশি দিন দলকে অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। ভিন্ন অবস্থানের আটটি রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়ে একটি সরকার গঠন করলে এলডিপিকে সেবার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল বটে, তবে জোটের শরিকেরা অল্পদিনের ভেতরে নীতিগত বিভিন্ন প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু করে দিলে সেই সুযোগ গ্রহণ করে জোটের সবচেয়ে বড় দলটিকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে এলডিপি আবারও ক্ষমতায় বসে গিয়েছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত চলছে এলডিপির দ্বিতীয় দফার রাজত্ব, যার সমাপ্তি সূচিত হতে যাচ্ছে চলতি মাসের ১৬ তারিখে নতুন একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
১৯৯৩ সালের সাময়িক সেই রদবদলের তুলনায় এবারে পরিস্থিতি অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৬ বছর আগে কোয়ালিশন সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হলেও এলডিপি তখন থেকে গিয়েছিল সংসদের বৃহত্তম দল, ফলে পর্দার আড়ালে রাজনীতির খেলায় মত্ত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি দলটির থেকে গিয়েছিল, যা কিনা শেষ পর্যন্ত দলকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে যায়। সেই তুলনায় ৩০ আগস্টের নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা এলডিপির জন্য অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ ময়দানের বিধ্বস্ত দৃশ্যপটের মতো চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পরাভূত বাহিনীর সৈনিক থেকে শুরু করে সেনাপতিদের মৃতদেহ, পিছু হটে গিয়ে নতুন রণকৌশল ঠিক করে নেওয়ার মতো সামর্থ্য যাদের এখন আর নেই। ফলে এটাকে বলা যায়, যেন একটি যুগের অবসান, যে যুগ জাপানকে সমৃদ্ধি আর অগ্রগতি এনে দিলেও বঞ্চিত করেছে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে পারার মতো তৃপ্তির পরিপূর্ণ অনুভূতি পাওয়া থেকে। জাপানে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে হাজার পঞ্চাশেক মার্কিন সেনা নিয়মিতভাবে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখছে তাই কেবল নয়, একই সঙ্গে জাপানের বিদেশ ও প্রতিরক্ষা নীতিও থেকে গেছে ওয়াশিংটনের আজ্ঞাবাহী। নব নির্বাচিত জাপানি নেতৃত্ব এখন বলছে সেই পরিস্থিতির বদল তারা নিয়ে আসবে। কতটা তারা সফল হতে পারবে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে টোকিওর নীতি-নির্ধারকদের মুখ থেকে যে এ রকম বক্তব্য বের হয়ে আসছে, তার তাত্পর্য আসলেই গভীর।
দুই কক্ষবিশিষ্ট জাপানি সংসদের নিম্নকক্ষের মোট আসনসংখ্যা হচ্ছে ৪৮০। এর মধ্যে ৩০০ আসনে নির্বাচন হয়ে থাকে সরাসরি বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যে এবং অবশিষ্ট ১৮০ আসন নির্ধারণ করা থাকে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হিসাবে বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টনের জন্য। ৩০ আগস্টের নির্বাচনে বিজয়ী গণতান্ত্রিক পার্টি ডিপিজে পেয়েছে ৩০৮ আসন অর্থাত্ দুই-তৃতীয়াংশের সামান্য কম। এই বিশালসংখ্যক আসন এককভাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ দলের জন্য করে দিলেও ডিপিজে ইতিমধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দুটি দলকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে, যা কিনা কৌশলগত দিক থেকে বেশকিছু সুবিধা দলের জন্য এনে দেবে।
প্রথম সুবিধা হচ্ছে উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত হওয়া। বিভিন্ন আইন বাস্তবায়িত করতে হলে যার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী। জাপানের সংবিধানে আইন প্রণয়নের যে নিয়ম নির্ধারণ করা আছে, নিম্নকক্ষের বাড়তি সুবিধা ভোগ করা তাতে লক্ষ করা যায়। সংসদে পেশ করা যেকোনো বিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে শুরুতে নিম্নকক্ষে পাস হওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদন লাভের জন্য উচ্চকক্ষে তা পাঠানো হয়। উচ্চকক্ষ সেই বিল বাতিল করে দিলে আবারও তা নিম্নকক্ষে ফিরে আসে এবং সেখানে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা পাস হলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। ফলে সংখ্যাগত হিসাব-নিকাশের এ রকম মারপ্যাঁচে নিরাপদ অবস্থান ধরে রাখার জন্য উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীন দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ গণতন্ত্রী দল ও নিউ পিপলস পার্টির সঙ্গে ডিপিজে জোটবদ্ধ হওয়া উচ্চকক্ষে জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে দেবে। ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রয়োজন হওয়া আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ নতুন সরকারের পক্ষে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
ডিপিজের নির্বাচনী এবং নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিশ্রুতিকেও সহজেই সুদূরপ্রসারী আখ্যায়িত করা যায়। মার্কিন সামরিক উপস্থিতি হ্রাসের উল্লেখ দলের পক্ষ থেকে সরাসরি করা না হলেও দলীয় নেতৃত্ব বলছে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর মর্যাদাসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সংশোধন করে নেওয়ার অনুরোধ তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জানাবে। এ ছাড়া ওকিনাওয়া দ্বীপে ব্যাপক মার্কিন উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরুর আহ্বানও দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
অন্যদিকে বিদেশে জাপানের সামরিক উপস্থিতির দিকটিও নতুনভাবে বিচার-বিবেচনা করে দেখা হবে। ইরাকে জাপানের সরাসরি সামরিক উপস্থিতি কয়েক বছর আগেই গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিদেশের যে দুটি সামরিক মিশনে জাপান এখন অংশ নিচ্ছে তা হলো, ভারত মহাসাগরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের জাহাজের জন্য নিখরচায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা এবং সোমালিয়ার অদূরে জলদস্যু দমনে আত্মরক্ষা নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠানো।
ভারত মহাসাগরের জাপানি মিশন সম্পর্কে নতুন প্রশাসনের পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে, জানুয়ারি মাসে মিশনের বৈধতা দেওয়া বর্তমান আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তা আর বৃদ্ধি করা হবে না। অর্থাত্, জাপানের যে দুটি ডেস্ট্রয়ার ও সরবরাহ জাহাজ ২০০১ সালের নভেম্বর মাস থেকে দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপের আশপাশে মোতায়েন রয়েছে, সেগুলোকে অচিরেই দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে জাপানের প্রতিরক্ষা প্রভু স্বাভাবিকভাবেই নতুন সরকারের তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্তে উষ্মা প্রকাশ করে মিশন অব্যাহত রাখার অনুরোধ টোকিওর প্রতি জানায়। অন্যদিকে সোমালিয়ার মিশন অন্য কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক তত্পরতা না হওয়ায় এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। নতুন কোয়ালিশন সরকারের শরিক সমাজ গণতন্ত্রী দল অবশ্য দাবি জানিয়েছে যে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীকে ফিরিয়ে এনে এবং উপকূল রক্ষী দলকে সেই মিশনে যেন পাঠানো হয়।
তবে আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতাসীন হতে যাওয়া নতুন সরকারের সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে চালিত করায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগ।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ও দেশের আগামী প্রধানমন্ত্রী ইয়ুকিও হাতোইয়ামা মার্কিন নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে চাপিয়ে দেওয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিকে ‘বাজারের মৌলবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যে অর্থনীতির মূল লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ নয়, বরং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। হাতোইয়ামা বলছেন, জাপানের অর্থনীতিকে তিনি জনতার কল্যাণের পথে ফিরিয়ে আনবেন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত রাজনীতি প্রবর্তনের অঙ্গীকারও তিনি করেন।
ফলে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিনের স্থবিরতার অবসানে ধীরে বাম দিকে মোড় নিতে চলেছে জাপান। চলতি মাসের ১৬ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া জাপানের নতুন প্রশাসনের দিকে তাই স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে বিশ্বের উত্সুক দৃষ্টি।
টোকিও, ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.