বিভাজন সৃষ্টিই ছিল এই নারকীয় ঘটনার অন্যতম উদ্দেশ্য by লায়লা নাজনীন হারুন

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০-এর দৈনিক সংবাদপত্রগুলো হাতে নিতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরম্ন হয়। পিছু ফিরে চায় মন। দু'চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। চোখের পাতা ভিজে ভারি হয়ে ওঠে অলৰ্যেই।
গত বছর ঠিক এ দিনটিতে সকালের এ সময়টাতেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পিলখানাতে ঘটানো হয় স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ ও নৃশংসতম বর্বরোচিত হত্যাকা-। নিজ রক্ত সম্পর্কীয় অথবা কোন আত্মীয় আমার ছিল না নিহত অফিসারদের কেউ। তবু চোখে এলো জল, হু হু করে উঠল বুক, কষ্ট-ব্যথায় মাখামাখি করে একাকার হয়ে রইল অন্তরাত্মা সবকিছু। কবির ভাষায় বলছি, আজ আমি কাঁদতে চাই না আজ আমি আমার কণ্ঠের সবটুকু শক্তি দিয়ে উচ্চস্বরে ওদের বিচার চাই, ওদের বিচার চাই। অনেক সময় নিয়ে তদন্ত কাজটি শেষ হয়েছে।
বিচারকার্যও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি হলো, বিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তারা যেন একশ' ভাগ স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারেন তদনত্মকার্যে। কেননা তাদের নির্ভুল তদন্তের ওপরই নির্ভর করছে বিচারকার্যটি এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যুগেও যেন আর কোন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে মুখ বুজে কাঁদবার সুযোগ না পায়।
বিডিআরের এ নৃশংসতম হত্যাকা- সম্পর্কে দেশের বুদ্ধিজীবী, সুধীজন ও সাধারণ মানুষ নানা রকম মন্তব্য ও অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। এক এক জনের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক এক রকম কারণ নিরূপণ করা হয়েছে। এর কোনটাই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। একদিনে হঠাৎ করেই যে পৃথিবী কাঁপানো এ ভয়াবহ হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়েছে তা নয়। ডাল-ভাত কর্মসূচীর প্রোগ্রাম জওয়ানদের না হওয়ার ৰোভও শুধু নয়। তাদের সঙ্গে অফিসারদের বিরূপ আচরণের পুঞ্জীভূত বেদনার কারণও এটা হতে পারে না। দেশের বেশিরভাগ সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতের সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করি নির্দ্বিধায়। এ নৃশংসতম নজিরবিহীন হত্যাকা-টি ঘটানোর পেছনে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ছিল; ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার নিলনক্সা। একদিন, এক সপ্তাহ কিংবা এক মাসের পরিকল্পনায় এহেন হীন ঘটনা ঘটানো কখন সম্ভব নয়। এক দিনে হঠাৎ করে ৫৭ জন তরতজা চৌকস সেনা অফিসার মেরে, আগুনে পুড়ে, অথবা সু্যয়ারেজের দুর্গন্ধময় নোংরা পানিতে ফেলে দেয়ার কর্মসূচী অনেক দিন ধরেই ধাপে ধাপে করতে হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের। জানা যায়, হত্যাকারীরা হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও রাতে বিডিআর মসজিদে বসে ফাইনাল প্রস্তুতির খুঁটিনাটি নিয়ে মিটিং করেছে।
কেন এমন পৈশাচিকভাবে জঘন্যতম নগ্ন উন্মত্ততায় বিপথগামী কিছু বিডিআর সদস্য এহেন হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত করল তা ভাবতে গেলে অনেক কারণই সামনে চলে আসে। তার মধ্যে দু'তিনটি কারণ দিনের আলোর মতো একেবারে জ্বল জ্বল হয়ে ওঠে। তার মধ্যে প্রথম কারণটি যেটা নিরূপণ করা হয়েছে তা হলো হানিমুন পিরিয়ডের একটি নতুন সরকারকে দারুণ বিপর্যয়ের মুখে ফেলে, সরকারকে গদিচ্যুত করার অপচেষ্টা। দ্বিতীয় কারণটি মনে করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সপৰের সরকারকে গদিচ্যুত করতে পারলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রায় অকার্যকর করাসহ যুদ্ধপরাধীদের বিচারকার্যটি চিরতরে থামিয়ে দেয়া যাবে। এর মধ্যে আরও অনেক বড় বড় অপকর্ম ও হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চিরতরে মুছে দেয়াই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের মূল উদ্দেশ্য। যেমন দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, পহেলা বৈশাখের গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া-আহসানুল্লাহ মাস্টার হত্যাসহ সব অপকর্মের বিচারকার্য শুরু হলে যাদের মুখোশ উন্মোচিত হবার সম্ভাবনা ছিল তারা কি কখনও চাইতে পারে এ সরকার পাওয়ারে থাক?
তৃতীয় এবং অন্যতম কারণটি হলো, এ ন্যক্কারজনক নিকৃষ্টতম বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটিয়ে তারা সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করে সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল। সেনাবাহিনী এবং বিডিআরকে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত করিয়ে দিতে পারলে দুই পক্ষেরই প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি, রক্তপাত, এমনকি অনেক সেনা ও বিডিআর সদস্যের প্রাণ যেত। শুধু তাই নয়, সেদিন যদি পিলখানায় দু'পক্ষেরই ভারি অস্ত্রের গোলাগুলি শুরু হতো তা হলে আশপাশের এলাকায় বিপুল ৰয়ৰতি ও অনেক মানুষের মৃতদেহের স্তূপে ভরে যেত ঐ এলাকা। ষড়যন্ত্রকারীরা তাই চেয়েছিল। এর ফলশ্রুতি হিসেবে পরবর্তীতে সেনাবাহিনী-বিডিআর পরস্পর পরস্পরকে চরম শত্রু ভাবত এবং পরস্পরের মধ্যে জিরো টলারেন্স এসে দাঁড়াত। আর এ নড়বড়ে পরিস্থিতির মাঝখানে সরকারকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সুদূরপ্রসারী একটা ফায়দা লুটতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।
যাঁরা চলে গেছেন অকালে আমাদের ছেড়ে, সে বেদনার ভার সইবার ৰমতা সত্যিই নেই আমাদের। তাঁদের জন্য সর্বদা প্রাণ কাঁদে মন হাহাকার করে। প্রশ্ন জাগে মনে, যারা দেশের তরে সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি ছিল তাঁদের প্রস্থানটা এমন হলো কেন? ওরা তো আমাদেরই সহোদর স্বজন। যে বৃদ্ধা মা ইউনিফর্ম পরিহিত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সকালে বিদায় দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা, কিন্তু ছেলে আর ফিরলই না মায়ের কাছে। যে স্নিগ্ধ স্ত্রী নাস্তার টেবিলে হাসিমুখে স্বামীকে মনে করিয়ে দিলেন আজ কিন্তু বিকেলে বাবুর স্কুলের ইউনিফর্ম কিনতে যাব, কিন্তু সে বিকেলটি আর ফিরল না সেই স্বামীর গর্বে গরবিনী স্ত্রীর জীবনে। যে ছোট্ট ছেলেটি অথবা কিশোরী মেয়েটি প্রিয় বাবার হাত টেনে ধরে সকালে বলল, আব্বু আজ বিকেলে তোমার সঙ্গে পাগলা জিমখানা দেখতে যাব; তাড়াতাড়ি এসো। সেই বাবাও আর ফিরে এলো না প্রাণপ্রিয় সন্তানদের কাছে। কি অন্যায় কি অপরাধ ছিল ওদের? কোন্ সান্তনায় ওরা শান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল? কোন্ অমোঘ বাণী মুছে দেবে ওদের বুকের দগদগে ক্ষত। যাই হোক, নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের হীনউদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যারা সর্বদা বলে বেড়াচ্ছে সরকার কেন তখনি সেনাবাহিনীকে পাঠাল না বিডিআরকে রুখতে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সেনাবাহিনী সব সময় রণসাজে সজ্জিত থাকে না। সেনাবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাগুলি থাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বা অস্ত্রাগারে। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গাড়িসহ কনভয় তৈরি করে ব্রিফিং ও মুভ অর্ডার নিয়ে রওনা হতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয় সৈনিকদের। অর্ডার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্র নিয়ে এক দৌড়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে যুদ্ধ করা যায় না, এটা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এসব প্রয়োজন ও পরিকল্পনার আগেই হত্যাকারীরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে গুলি শেষ করে ফেলেছিল। সেনাবাহিনীর কিছু করার ছিল না। তারপরেও যদি সেনাবাহিনী গিয়ে সেখানে বিডিআরের সংগে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতো তার ফল হতো ভীষণ ভয়াবহ। আর তা হতো দেশে এবং দেশের বাইরেও ভয়াবহ এক ধিক্কৃত অধ্যায়। বাংলাদেশের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হতো বিশ্বের দরবারে। আবারও বলতে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, স্বকীয় দক্ষতা ও তীৰ্ন সাহস আর বিচক্ষণতার কারণেই দেশ সেদিন অনেক বড় বিপর্যয় ও ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এসব কিছু থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেনাবাহিনীকে বিডিআরের প্রতিপৰ করে তোলাও ষড়যন্ত্রে হয়েছিল। এসব ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা ছিল, ধীরে ধীরে সেসব দিনের আলোর মতো মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এদেশে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই বলে যেসব সাম্প্রদায়িক শক্তি, রাজনৈতিক দল অথবা ধর্মব্যবসায়ী গলাবাজি করেছিল, তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ না হওয়ায় আজ তারা চরম হতাশায় নিমজ্জিত। তারা অবশ্যই বুঝতে পেরেছে এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার, ধর্মান্ধতার, গলাবাজি আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মূলোদ্ঘাটন করতে বদ্ধপরিকর। মুক্তিযুদ্ধের সপৰের শক্তি একজোট হয়ে ঐ অপশক্তিকে বিনাশ করবেই আর সেদিন বেশি দূরে নয়। আমরা শহীদের পবিত্র রক্তধোয়া মাটিকে আর কলঙ্কিত করতে দেব না। এ মাটিতে আমরা চাই না আর কোন গ্রেনেড হামলার মহোৎসব।
আমরা যাদের হারিয়েছি, তারা প্রত্যেকেই আমাদের আত্মার সঙ্গে গ্রোথিত হয়ে আছে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। আমরা চাই সরকার যেন এ বিচারকার্যটি সঠিক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবেই করতে পারে। দেশের আধা সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত। তারা আমাদের অহঙ্কারের প্রতীক। সেনাবাহিনী ও বিডিআর সকলেই আমাদের দেশকে সুরক্ষিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে কোন বিভাজন সৃষ্টি হওয়া জাতীয় স্বার্থে বা নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
স্বার্থান্বেষী মহলের এ ধরনের অশুভ পাঁয়তারা রোধ করার দৃঢ় পদৰেপ এখনি নিতে হবে সরকার এবং দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে। বিজয়ের অহঙ্কারের মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার চায় প্রিয় মাতৃভূমি।

No comments

Powered by Blogger.