একজন রোকসানার উঠে আসা

‘হেডব্যান্ড’ বেঁধে ফুটবল খেলে রোকসানা পারভীন। ফ্যাশন নয়, কাঁধ বেয়ে নেমে আসা বেয়াড়া চুলগুলোকে বাধ্য রাখতেই দরকার এই হেডব্যান্ড। যা আসলে এক টুকরো কাপড়।
রংপুর পালিচড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কিশোরী মেয়েটি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা স্কুল ফুটবলে টানা দুবার জিতল টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কার।
গত টুর্নামেন্টে ১১ ম্যাচে করেছিল ২১ গোল, এবার ৯ ম্যাচে ২০। সর্বোচ্চ গোলদাতা ও টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কারের সঙ্গে পরশুর ফাইনালে দারুণ দুটি গোলের সুবাদে হয়েছে ম্যাচসেরা। এত এত পুরস্কার—অথচ মনখোলা হাসি নেই পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীটির। কৃষক বাবা দেলোয়ার হোসেন একসময় ফুটবল খেলতেন। মেয়েকেও ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। একেই ‘নুন আনতে পানতা ফুরোনো’ অবস্থা সংসারের। তার ওপর পক্ষাঘাতে চার বছর ধরে প্রায় অকর্মণ্য পড়ে আছেন বাবা। তাই কোথাও খেলার সুযোগও মিলত না রোকসানার। তার কাছে হঠাৎই বঙ্গমাতা ফুটবল আশীর্বাদ হয়ে আসে। ভালো খেলার সুবাদেই সে পালিচড়া প্রাইমারি স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবেদ আলীর চোখে পড়ে। রোকসানাকে নিজের স্কুলে ভর্তি করার পাশাপাশি রেখে দেন নিজের বাড়িতে। আবেদ আলী তার দূরসম্পর্কের নানা, কিন্তু এখন অতি আপনজন।
গত বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলের ফাইনাল খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার দুঃখটা এখনো পোড়ায় রোকসানাকে। এবার তাই পাখির চোখ ছিল শিরোপা। সেই শিরোপা জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে সে আনন্দিত। এতটাই যে অনুভূতি ঠিকমতো বোঝাতে পারছিল না। শুধু বলতে পারল, ‘আমার খু-ব ভালো লাগছে।’ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে পরশু নিজের ট্রফি, সনদ ও পদক হাতে নিয়ে যখন দাঁড়াল, চারপাশে জ্বলছিল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কেউ ব্যস্ত মুঠোফোনে ছবি তুলতে। রংপুর থেকে আসা স্বজনেরা তখন আনন্দে ‘রোকসানা, রোকসানা’ ধ্বনি তুলছিলেন। কিন্তু এত স্বজনের ভিড়েও সে খুঁজছিল বড় ভাইকে। ঢাকায় পোশাকশ্রমিক তার সহোদর মোহাম্মদ হানিফ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পারলেও নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে ঢুকতে পারেনি মাঠে।
রোকসানার বাঁ পায়ে যেন কিছু জানে। ঠিকমতো খেতে পায় না, পায় না নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ। তবুও মাঠে নামলেই সে ‘গোলমেশিন’। এবার প্রতিটি ম্যাচেই সে গোল করেছে। দলের ম্যানেজার ও স্থানীয় সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলছিলেন, ‘ও আসলে সহজাত প্রতিভা। কিন্তু জন্মেছে গরিবের ঘরে। কত দূর যেতে পারবে সেটাই দেখার।’ রোকসানার একটাই ইচ্ছা, বিকেএসপিতে ভর্তি হবে। কিন্তু নিজের অক্ষমতাও যে তার অজানা নয়, ‘আমার বিকেএসপিতে পড়ার খুব ইচ্ছা। কিন্তু কীভাবে সেখানে সুযোগ মিলবে সেটা জানি না। কোথা থেকে টাকা জোগাড় হবে সেটা ভাবতেও ভয় হয়।’ আর্থিক অসচ্ছলতা কিশোরীর স্বপ্নটাকে যেন ছোবল দিচ্ছে সর্বক্ষণ।

No comments

Powered by Blogger.